ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার প্রধান কারণ হলো মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হওয়া। এটি মূলত দুটি উপায়ে ঘটতে পারে। প্রথমত, মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যাকে ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke) বলা হয়। এর প্রধান কারণ হলো রক্তনালীতে চর্বি জমা (Atherosclerosis), যা ধীরে ধীরে নালীকে সরু করে ফেলে অথবা অন্য কোনো স্থান থেকে রক্ত জমাট বেঁধে এসে মস্তিষ্কের নালী আটকে দেয় (Embolism)। দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে রক্তক্ষরণ হয়, যাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke) বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কের দুর্বল রক্তনালী ফেটে যাওয়া এর একটি প্রধান কারণ। এছাড়াও, মস্তিষ্কের রক্তনালীর অস্বাভাবিক গঠন (Aneurysm) বা কোনো আঘাতের কারণেও রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে। এই পোস্টে আপনারা ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ নিয়ে জানতে পারবেন।
কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) স্ট্রোকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ। দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপ রক্তনালীগুলোকে দুর্বল করে ফেলে এবং ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। উচ্চ কোলেস্টেরল (High Cholesterol) রক্তনালীতে চর্বি জমাতে সাহায্য করে, যা ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিস (Diabetes) শরীরের রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ে।
হৃদরোগ (Heart Disease), বিশেষ করে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Atrial Fibrillation), রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায় এবং মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ধূমপান (Smoking) রক্তনালীকে সরু করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, যা স্ট্রোকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা (Obesity) সরাসরি স্ট্রোকের কারণ না হলেও, এটি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
আমাদের জীবনযাত্রার কিছু অভ্যাসও ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাবার, বিশেষ করে ফ্যাট ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার বেশি খেলে রক্তনালীতে চর্বি জমার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করলে রক্ত চলাচল কমে যায় এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত মদ্যপান রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
মাদক দ্রব্য ব্যবহার মস্তিষ্কের রক্তনালীর উপর সরাসরি খারাপ প্রভাব ফেলে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে এবং যাদের পরিবারে আগে কারো স্ট্রোক হয়েছে তাদেরও এই রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিছু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও স্ট্রোকের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় এই পোস্ট থেকে জানুন।
ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ বা বিশেষ কারণগুলো
মস্তিষ্কে রক্ত যাওয়া বন্ধ হলে
আমাদের মস্তিষ্কের কাজ করার জন্য সবসময় রক্তের দরকার হয়। রক্তই অক্সিজেন আর খাবার নিয়ে যায়। কোনো কারণে যদি মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেই অংশে রক্ত পৌঁছাতে পারে না। অনেকটা রাস্তায় জ্যাম লাগলে যেমন গাড়ি যেতে পারে না, তেমনই। যখন রক্ত যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় (একে বলে ইস্কেমিক স্ট্রোক), তখন মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে শুরু করে। এটা হওয়ার দুটো প্রধান কারণ আছেঃ
প্রথম কারণ হলো রক্তনালীতে চর্বি জমা। আমাদের খাবারের খারাপ তেল আর চর্বি ধীরে ধীরে নালীর ভেতরে জমতে থাকে। এতে নালীটা সরু হয়ে যায়, আর রক্ত ঠিকমতো যেতে পারে না। অনেকটা পুরনো জলের পাইপে যেমন ময়লা জমে যায় তেমনই। দ্বিতীয় কারণ হলো অন্য কোথাও জমাট বাঁধা রক্ত ছুটে এসে মস্তিষ্কের সরু নালীতে আটকে যায়। ধরুন, হার্টে বা অন্য কোনো রক্তনালীতে রক্তের ডেলা তৈরি হলো, আর সেটা ভেসে গিয়ে মস্তিষ্কের ছোট নালীটা বন্ধ করে দিল।
মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে
মাঝে মাঝে মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়েও যেতে পারে, যাকে বলে হেমোরেজিক স্ট্রোক। যখন এটা হয়, তখন রক্ত মস্তিষ্কের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। এই রক্ত মস্তিষ্কের কোষগুলোর উপর চাপ দেয় এবং তাদের ক্ষতি করে। অনেকটা বেলুনের মধ্যে বেশি হাওয়া ভরে দিলে যেমন ফেটে যায়, তেমনই দুর্বল রক্তনালী বেশি চাপের কারণে ফেটে যেতে পারে।
এই রক্তনালী ছিঁড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো অনেক দিনের উচ্চ রক্তচাপ। যাদের ব্লাড প্রেসার বেশি থাকে, তাদের মস্তিষ্কের ছোট নালীগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজেই ফেটে যেতে পারে। এছাড়াও, কিছু লোকের মস্তিষ্কের রক্তনালী জন্ম থেকেই একটু দুর্বল থাকে (অ্যানিউরিজম)। এই দুর্বল জায়গাগুলো হঠাৎ করে ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। মাথায় খুব জোরে আঘাত লাগলেও মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে।
গ্যাস থেকে কি স্ট্রোক হয় কি না তা জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।
কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা যা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়
ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার পেছনে আমাদের কিছু শারীরিক অবস্থা বা স্বাস্থ্য সমস্যা বড় ভূমিকা রাখে। এগুলো সরাসরি স্ট্রোক না ঘটালেও, স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। নিচে এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure): প্রধান কারণ
উচ্চ রক্তচাপ হলো ব্রেইন স্ট্রোকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান ঝুঁকির কারণ। আমাদের রক্তনালীর মধ্যে দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় যে চাপ সৃষ্টি হয়, সেটাই রক্তচাপ। যখন এই চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে। দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপ মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলোকে দুর্বল করে ফেলে। দুর্বল হয়ে যাওয়া রক্তনালীগুলো সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে (হেমোরেজিক স্ট্রোক) অথবা শক্ত ও সরু হয়ে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে (ইস্কেমিক স্ট্রোক)। এছাড়া, উচ্চ রক্তচাপ রক্তনালীর ভেতরের দেওয়ালে চর্বি জমা হওয়ার প্রক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে, যা ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়ায়। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করানো এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা ব্রেইন স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
উচ্চ কোলেস্টেরল (High Cholesterol): রক্তনালীতে চর্বি জমাতে সাহায্য করে
কোলেস্টেরল হলো আমাদের রক্তে থাকা এক ধরনের চর্বি জাতীয় পদার্থ। আমাদের শরীরের কোষ তৈরি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কোলেস্টেরলের প্রয়োজন হলেও, রক্তে এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। উচ্চ কোলেস্টেরল রক্তনালীর ভেতরের দেওয়ালে জমা হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে প্ল্যাক (Plaque) তৈরি করে। এই প্ল্যাক রক্তনালীকে সরু করে ফেলে এবং রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, যা ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, এই প্ল্যাক ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে এবং রক্তনালী সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে পারে। তাই, খাবারের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস (Diabetes): রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে আমাদের শরীরে রক্তের শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্ত শর্করা শরীরের বিভিন্ন রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার মধ্যে মস্তিষ্কের রক্তনালীও অন্তর্ভুক্ত। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালীগুলো শক্ত ও সরু হয়ে যেতে পারে, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, ডায়াবেটিস রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতাও বাড়াতে পারে। যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
হৃদরোগ (Heart Disease): রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়
বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (Atrial Fibrillation), একটি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন যা হৃদপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠে দ্রুত এবং এলোমেলো স্পন্দনের সৃষ্টি করে। এই কারণে হৃদপিণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং এই জমাট বাঁধা রক্ত যদি মস্তিষ্কের রক্তনালীতে গিয়ে আটকে যায়, তাহলে এমবোলিক স্ট্রোক হতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য হৃদরোগ যেমন করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary Artery Disease) এবং হার্ট ফেইলিউরও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। হৃদরোগের সঠিক চিকিৎসা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা ব্রেইন স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ধূমপান (Smoking): রক্তনালী সরু করে ও রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি ব্রেইন স্ট্রোকের একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ। সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালীগুলোর ভেতরের স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে রক্তনালীগুলো শক্ত ও সরু হয়ে যায় (Atherosclerosis), যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, ধূমপান রক্তকে ঘন করে তোলে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, যা স্ট্রোকের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়। ধূমপান ত্যাগ করা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা (Obesity): অন্যান্য ঝুঁকি বাড়ায়
অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা সরাসরি ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ না হলেও, এটি এমন কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায় যা পরবর্তীতে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সবই ব্রেইন স্ট্রোকের গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ। তাই, একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ব্রেইন স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস কিভাবে হয় জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
জীবনযাত্রার কিছু অভ্যাস
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কিছু অভ্যাস আমাদের শরীরে এমন পরিবর্তন আনতে পারে যা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই অভ্যাসগুলো সরাসরি স্ট্রোক না ঘটালেও, ধীরে ধীরে শরীরের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করে এবং স্ট্রোকের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। নিচে এই অভ্যাসগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
অস্বাস্থ্যকর খাবারঃ ফ্যাট ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার বেশি খাওয়া
আমাদের খাদ্যাভ্যাস সরাসরি আমাদের শরীরের রক্তনালী এবং রক্তপ্রবাহের উপর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ফ্যাট (যেমন – সম্পৃক্ত ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাট) এবং কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার বেশি খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। এই খারাপ কোলেস্টেরল রক্তনালীর ভেতরের দেওয়ালে জমা হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে প্ল্যাক তৈরি করে। এই প্ল্যাক রক্তনালীকে সরু করে ফেলে এবং রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, যা ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার শরীরের ওজন বাড়াতেও সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় – এই সবগুলোই স্ট্রোকের জন্য দায়ী। তাই, ফল, সবজি, শস্য এবং কম ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণ করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
শারীরিক পরিশ্রম না করাঃ রক্ত চলাচল কমে যায়
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে অপরিহার্য। যখন আমরা শারীরিক পরিশ্রম করি না, তখন আমাদের হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে। এছাড়া, শারীরিক পরিশ্রম না করলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকিও বাড়ে – এই সবই ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য দায়ী। নিয়মিত হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা বা অন্য কোনো ধরনের ব্যায়াম আমাদের হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত মদ্যপানঃ রক্তচাপ বাড়াতে পারে
অ্যালকোহল বা মদ্যপান আমাদের শরীরের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত মদ্যপান করলে উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী হতে পারে, যা ব্রেইন স্ট্রোকের একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ। এছাড়াও, অতিরিক্ত মদ্যপান হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে, যা পরবর্তীতে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ায়। পরিমিত পরিমাণে মদ্যপান করাও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই মদ্যপান এড়িয়ে চলাই ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায়।
মাদক দ্রব্য ব্যবহারঃ রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে
বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্য (যেমন – কোকেইন, অ্যাম্ফিটামিন) সরাসরি মস্তিষ্কের রক্তনালীর উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু মাদক দ্রব্য রক্তনালীকে সংকুচিত করে ফেলে, যার ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। আবার কিছু মাদক দ্রব্য রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে, যা মস্তিষ্কের দুর্বল রক্তনালী ছিঁড়ে হেমোরেজিক স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। মাদক দ্রব্য ব্যবহার শরীরের অন্যান্য অঙ্গেরও ক্ষতি করে এবং সামগ্রিকভাবে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। মাদক দ্রব্য পরিহার করা ব্রেইন স্ট্রোক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে অত্যন্ত জরুরি।
ধূমপানের কারণে স্ট্রোক হয়? জানুন এর বিস্তারিত
অন্যান্য কারণ
কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে যা সরাসরি আমাদের জীবনযাত্রার অভ্যাস বা স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে যুক্ত না হলেও ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এই কারণগুলো সম্পর্কে জানা আমাদের সচেতন থাকতে এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে সাহায্য করতে পারে। নিচে এই কারণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
বয়সঃ বেশি বয়সে ঝুঁকি বাড়ে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারিতা কমতে শুরু করে, রক্তনালীগুলো দুর্বল ও শক্ত হয়ে যেতে পারে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই কারণে বেশি বয়সে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। সাধারণত ৫৫ বছর বয়সের পর প্রতি দশ বছর অন্তর স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হতে থাকে। যদিও কম বয়সেও স্ট্রোক হতে পারে, তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এর প্রবণতা অনেক বেশি। তাই, বয়স একটি অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকির কারণ হলেও, বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন থাকা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।
পারিবারিক ইতিহাসঃ পরিবারে কারো স্ট্রোক হয়ে থাকলে ঝুঁকি বাড়ে
যদি কোনো ব্যক্তির পরিবারে (যেমন – বাবা, মা, ভাই, বোন) আগে কারো ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির নিজেরও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়। এর কারণ হলো কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য বা বংশগত রোগ থাকতে পারে যা রক্তনালীকে দুর্বল করে বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার (যেমন – উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস) প্রবণতা বাড়ায়, যা পরবর্তীতে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। তবে পারিবারিক ইতিহাস থাকা মানেই যে স্ট্রোক হবে তা নয়, বরং এটি একটি অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যাদের পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস আছে, তাদের উচিত স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা এবং নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
জাতিঃ কিছু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঝুঁকি বেশি দেখা যায়
গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। এর কারণ হতে পারে জিনগত বৈশিষ্ট্য, জীবনযাত্রার অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাস অথবা স্বাস্থ্যসেবার সুযোগের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। জাতি একটি অপরিবর্তনীয় ঝুঁকির কারণ হলেও, এই বিষয়ে সচেতনতা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করতে পারে।
কিছু ঔষধঃ কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় স্ট্রোক হতে পারে (বিরল)
কিছু নির্দিষ্ট ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিরল ক্ষেত্রে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল (Birth Control Pills), বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন বা যাদের উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্যান্য ঝুঁকি রয়েছে। কিছু হরমোন থেরাপি এবং মাইগ্রেনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধও স্ট্রোকের ঝুঁকি সামান্য বাড়াতে পারে। তবে এই ঝুঁকি সাধারণত খুবই কম এবং ওষুধ শুরু করার আগে ডাক্তার এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কোনো ওষুধ সেবন করার সময় যদি স্ট্রোকের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
স্ট্রোক রোগীর বিশেষ জরুরি চিকিৎসা এই পোস্টের মাধ্যমে জানুন।
উপসংহার
মোটকথা, ব্রেইন স্ট্রোক একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা যার পেছনে বহু কারণ জড়িত। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া অথবা রক্তনালী ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হওয়া – এই দুটি প্রধান উপায়ে স্ট্রোক ঘটতে পারে। রক্তনালীতে চর্বি জমা, রক্ত জমাট বাঁধা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালী দুর্বল হয়ে ফেটে যাওয়া ইস্কেমিক ও হেমোরেজিক স্ট্রোকের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়াগুলো বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কিছু অভ্যাসও স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাবার, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং মাদক দ্রব্যের ব্যবহার আমাদের রক্তনালী ও হৃদযন্ত্রের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে, যা স্ট্রোকের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, বয়স বৃদ্ধি, পারিবারিক ইতিহাস এবং জাতিগত কিছু বৈশিষ্ট্যও স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণ হতে পারে, যদিও এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও স্ট্রোক ঘটাতে পারে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্রেইন স্ট্রোকের অনেক কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে আমরা স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারি। স্ট্রোক একটি মারাত্মক রোগ হলেও, এর কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ নিউরোফিট