প্যারালাইসিস হলে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ, বিশেষ করে হাত-পা দুর্বল বা সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যেতে পারে। এতে স্বাভাবিক চলাফেরা ও দৈনন্দিন কাজকর্মে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় স্ট্রোক, স্নায়ুর সমস্যা বা দুর্ঘটনার কারণে প্যারালাইসিস হতে পারে, যার ফলে রোগীর মানসিক ও শারীরিক কষ্ট বেড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ ধরনের প্যারালাইসিস রোগীর ব্যায়াম ও থেরাপির মাধ্যমে হাত-পায়ের দুর্বল পেশি ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেতে শুরু করে। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম করলে পেশির কার্যক্ষমতা বাড়ে, রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয় এবং রোগী আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পায়।
প্যারালাইসিস রোগীর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম রয়েছে, যেমন-প্যাসিভ মুভমেন্ট, গ্রিপিং এক্সারসাইজ এবং রেঞ্জ-অফ-মোশন এক্সারসাইজ। এসব ব্যায়াম খুব সহজ ও নিরাপদ, এবং বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে নিয়মিত করলে হাত-পায়ের শক্তি ও কার্যক্ষমতা অনেকটাই ফিরে পাওয়া সম্ভব। তাই প্যারালাইসিস রোগীর দ্রুত উন্নতির জন্য ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী।
গ্যাস থেকে স্ট্রোক হয় কি না তা জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ুন।
রোগীর প্রাথমিক মূল্যায়ন ও বিশেষ পরিকল্পনা
রোগীর হাত-পায়ে শক্তি ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো রোগীর বর্তমান শারীরিক অবস্থা ও দুর্বলতা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। প্যারালাইসিসের কারণে কারও হাত-পা একেবারে নড়াচড়া করতে পারে না, আবার কারও ক্ষেত্রে কিছুটা শক্তি থাকলেও স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় না। তাই ফিজিওথেরাপিস্ট প্রথমে রোগীর হাত-পা কতটা নড়াচড়া করতে পারে, কোন কোন জয়েন্ট বা পেশিতে কতটুকু শক্তি আছে, কোথায় বেশি দুর্বলতা বা অবশভাব রয়েছে-এসব বিষয় ভালোভাবে পরীক্ষা করেন। এ ছাড়া রোগীর বয়স, অন্যান্য শারীরিক সমস্যা, প্যারালাইসিস হওয়ার কারণ ও কতদিন ধরে এই সমস্যা রয়েছে, এসব বিষয়ও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এই মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগীর দুর্বলতা ও সক্ষমতার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়, যা পরবর্তী চিকিৎসা ও ব্যায়ামের পরিকল্পনায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।
প্রতিটি রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং প্রয়োজন আলাদা, তাই সবার জন্য এক ধরনের ব্যায়াম কার্যকর হয় না। রোগীর দুর্বলতা, শক্তি ও উন্নতির সম্ভাবনা বিবেচনায় ব্যক্তিগতভাবে ব্যায়ামের পরিকল্পনা করা হয়। শুরুতে সাধারণত সহজ ব্যায়াম দিয়ে শুরু করা হয়, যেমন-প্যাসিভ মুভমেন্ট, যেখানে ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর হাত-পা আস্তে আস্তে নাড়ান, যাতে পেশিগুলো নরম ও নমনীয় থাকে।
এরপর ধীরে ধীরে রোগী নিজে হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করেন, যেমন-গ্রিপিং এক্সারসাইজ, বল চেপে ধরা, আঙুল ভাঁজ করা ইত্যাদি। রোগীর অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচিং ও স্ট্রেনদেনিং ব্যায়াম যোগ করা হয়, যাতে পেশির শক্তি বাড়ে এবং জয়েন্টের নড়াচড়া স্বাভাবিক হয়। পরবর্তীতে বসা, দাঁড়ানো এবং হাঁটার অনুশীলন করানো হয়, যাতে রোগী ধাপে ধাপে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরে আসতে পারেন।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় রোগীর মানসিক উৎসাহ এবং পরিবারের সহযোগিতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ও পরিকল্পিতভাবে ব্যায়াম করলে প্যারালাইসিস রোগীর হাত-পায়ের শক্তি ও কার্যক্ষমতা অনেকটাই ফিরে আসে এবং তিনি আবারও স্বাভাবিক জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।
গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।
হাতের জন্য ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম
প্যারালাইসিসের পর হাতের শক্তি ফিরিয়ে আনতে কিছু সহজ ব্যায়াম নিয়মিত করা জরুরি। এই ব্যায়ামগুলো ধীরে ধীরে হাতের জোড়া নরম রাখে, পেশি শক্তিশালী করে এবং দৈনন্দিন কাজ করতে সাহায্য করে। চলুন step-by-step জেনে নিই:
প্যাসিভ মুভমেন্ট (অন্যের সাহায্য নিয়ে হাত নাড়ানো)
এই ব্যায়ামে রোগী নিজে হাত নাড়াতে না পারলেও ফিজিওথেরাপিস্ট বা বাড়ির কেউ তার হাত ধরে আস্তে আস্তে নাড়ান। যেমন: আঙুল ভাঁজ করা, হাত উপরে-নিচে তোলা, কনুই বাঁকানো বা কবজি ঘোরানো। এইভাবে হাতের জোড়াগুলো শক্ত হয়ে যাওয়া ঠেকানো যায়, রক্ত চলাচল বাড়ে এবং পেশি নরম থাকে। দিনে ২-৩ বার ১০-১৫ মিনিট করে এই ব্যায়াম করলে হাত ধীরে ধীরে নড়াচড়ার ক্ষমতা ফিরে পায়।
নিজে চেষ্টা করে হাত নাড়ানো (সামান্য সহায়তা নিয়ে)
যখন রোগী কিছুটা হাত নাড়াতে পারবেন, তখন তিনি নিজে চেষ্টা করবেন-আর প্রয়োজনে থেরাপিস্ট হাত ধরে সাহায্য করবেন। যেমন: আঙুল দিয়ে ছোট বল চেপে ধরা, হাতের তালু খোলা-বন্ধ করা বা টেবিল থেকে কাপ তুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। শুরুতে হাত কাঁপতে পারে বা ব্যথা লাগতে পারে, কিন্তু ধৈর্য্য রাখলে ধীরে ধীরে শক্তি বাড়বে। এই ব্যায়ামে হাতের পেশি নিজে থেকে কাজ করা শিখে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।
আঙুল ও কবজির ব্যায়াম
প্যারালাইসিসের পর হাত ও পায়ে দুর্বলতা আসাটা স্বাভাবিক। নিয়মিত সঠিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব। এখানে কিছু সহজ ব্যায়াম দেওয়া হলো যা আপনারা দিনে কয়েকবার করতে পারেন। তবে, একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়ামের নিয়ম ও সংখ্যা ঠিক করে নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
হাতের ব্যায়াম
আঙুল ভাঁজ করা ও খোলা
- আরাম করে বসুন বা শুয়ে থাকুন।
- ধীরে ধীরে আপনার হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করুন, যেভাবে কিছু ধরলে করেন।
- কিছুক্ষণ ধরে রাখুন।
- এরপর ধীরে ধীরে আঙুলগুলো সোজা করে খুলুন।
- এই ব্যায়ামটি ১০-১৫ বার করুন।
কবজি ঘোরানো
- আপনার হাতের তালু উপরের দিকে রাখুন।
- ধীরে ধীরে আপনার কবজি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরান (বৃত্তাকারে)।
- কয়েকবার ঘোরানোর পর, একই ভাবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরান।
- প্রতিদিকে ১০-১৫ বার ঘোরান।
হাত উঁচু করার ব্যায়াম (দেয়ালের সাহায্য)
- দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান বা বসুন।
- আপনার হাত দেয়ালের উপর রাখুন।
- আঙুলগুলো ব্যবহার করে ধীরে ধীরে আপনার হাত যতটা সম্ভব উপরের দিকে তোলার চেষ্টা করুন। যদি পুরোটা তুলতে অসুবিধা হয়, যতটুকু পারেন ততটুকুই করুন।
- কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন।
- ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আনুন।
- এই ব্যায়ামটি ১০-১৫ বার করুন।
প্যারালাইসিস রোগীর ব্যায়াম হিসেবে দৈনন্দিন কাজের অনুশীলন করুন
হাতের শক্তি ফিরে এলে ছোট ছোট কাজ করা শুরু করুন। যেমনঃ
- চামচ দিয়ে খাবার খাওয়া, গ্লাসে পানি ঢালা।
- শার্টের বোতাম লাগানো, জুতার ফিতে বাঁধা।
- কলম ধরে নাম সই করা বা ড্রয়িং করা।
এই কাজগুলো হাতের সূক্ষ্ম নড়াচড়া শেখায় এবং ব্রেনকে নতুনভাবে হাত চালানো শেখায়।
মনে রাখবেন, প্যারালাইসিসের পর হাত-পায়ের জোর ফিরে পেতে রোজ ব্যায়াম করা খুব দরকারি। খেয়াল রাখবেন, রোজ একই টাইমে (সকাল-বিকেল) ব্যায়ামগুলো করবেন। তাড়াহুড়ো করবেন না, আস্তে আস্তে নিজের জোর বাড়ান। যদি কোনো ব্যায়াম করার সময় ব্যথা লাগে, তখনই থামিয়ে আপনার থেরাপিস্টকে জানাবেন। ভালোভাবে ব্যায়াম শিখতে ছবি বা ভিডিও দেখতে পারেন, তাতে ভুল হওয়ার চান্স কম থাকে। নিয়মিত চেষ্টা করলে প্যারালাইসিসের পরও হাতের স্বাভাবিক ব্যবহার অনেকটাই ফিরে আসে। শুরুতে কঠিন লাগলেও ধৈর্য্য রাখুন-সবকিছু সময়ে ঠিক হয়ে যাবে।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে কি কি করণীয় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।
পায়ের জন্য ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম
পা নাড়ানো (প্যাসিভ ও অ্যাকটিভ)
- প্যাসিভ মুভমেন্টঃ যদি রোগী নিজে পা নাড়াতে অক্ষম হন, তবে অন্য কারো (যেমন – ফিজিওথেরাপিস্ট বা পরিবারের সদস্য) সহায়তায় পা নাড়ানো উচিত। রোগীকে চিৎ করে শুইয়ে তার এক পা ধরুন এবং ধীরে ধীরে হাঁটু ও হিপের জয়েন্টে ভাঁজ করুন ও সোজা করুন। এরপর পায়ের পাতা ধরুন এবং ধীরে ধীরে উপর-নিচে নাড়াচাড়া করুন। একইভাবে অন্য পায়ে করুন। এই ব্যায়াম রক্ত চলাচল বাড়াতে এবং জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
- অ্যাকটিভ মুভমেন্টঃ যখন রোগী নিজে সামান্য নড়াচড়া করতে সক্ষম হন, তখন তাকে নিজ চেষ্টায় পা নাড়াতে উৎসাহিত করুন। প্রথমে বিছানায় শুয়ে বা বসে হাঁটু সামান্য ভাঁজ করে উপরের দিকে তোলার চেষ্টা করতে পারেন, তারপর ধীরে ধীরে নামান।
গোড়ালি ও পায়ের আঙুল তুলা-নামানো ও ঘোরানো
- রোগীকে চিৎ করে শুতে বলুন।
- গোড়ালি তুলা-নামানোঃ ধীরে ধীরে শুধু গোড়ালির অংশ উপরের দিকে টানুন (পায়ের পাতা যেন ছাদের দিকে মুখ করে থাকে) এবং কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন। এরপর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামান। এটি ১০-১৫ বার করুন।
- পায়ের আঙুল তুলা-নামানোঃ পায়ের আঙুলগুলো যতটা সম্ভব উপরের দিকে টানুন এবং কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন। এরপর নিচের দিকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনুন। এটিও ১০-১৫ বার করুন।
- গোড়ালি ঘোরানোঃ ধীরে ধীরে গোড়ালিকে বৃত্তাকারে ঘোরান। প্রথমে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং পরে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরান। প্রতি দিকে ১০ বার করে করুন। এই ব্যায়ামগুলো পায়ের রক্ত চলাচল বাড়ায় এবং গোড়ালি ও পায়ের পাতার জড়তা কমায়।
হাঁটু ও হিপ ভাঁজ-সোজা করা
- রোগীকে চিৎ করে শুতে বলুন।
- হাঁটু ভাঁজ করা ও সোজা করাঃ প্রথমে এক পা হাঁটু থেকে ভাঁজ করে বুকের কাছে আনার চেষ্টা করুন, যতটা সম্ভব। এরপর ধীরে ধীরে পা সোজা করুন। একই ভাবে অন্য পায়ে করুন। প্রতি পায়ে ১০-১৫ বার করুন।
- হিপ ভাঁজ করা ও সোজা করাঃ এক পা সামান্য ভাঁজ করে বিছানা থেকে একটু উপরে তুলুন এবং ধীরে ধীরে নামান। খেয়াল রাখবেন যেন শুধু হিপের জয়েন্ট নড়ে। একই ভাবে অন্য পায়ে করুন। প্রতি পায়ে ১০-১৫ বার করুন। এই ব্যায়ামগুলো পায়ের পেশি শক্তিশালী করতে এবং হাঁটাচলার জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।
বিছানায় বসে বা শুয়ে পা তুলা-নামানো
- যখন রোগী বসতে সক্ষম হন, তখন বিছানার কিনারায় বসে পা সামান্য উপরের দিকে তুলুন এবং ধীরে ধীরে নামান।
- শুয়ে থাকা অবস্থায়ও এক এক করে পা বিছানা থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে তুলে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন এবং তারপর নামান।
- এই ব্যায়ামগুলো পায়ের পেশিগুলোকে সক্রিয় করে তোলে এবং ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
সহায়ক যন্ত্র দিয়ে হাঁটার অনুশীলন
- ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সহায়ক যন্ত্র (যেমন – ওয়াকার, ক্রাচ) ব্যবহার করে হাঁটার অনুশীলন শুরু করা যেতে পারে।
- প্রথমে অল্প দূরত্বে এবং ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করুন।
- এই অনুশীলন শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় পেশিগুলোর শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
কি কি কারণে স্ট্রোক হয় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।
স্ট্রেচিং ও শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম
প্যারালাইসিসের পর হাত ও পায়ের পেশি শক্ত হয়ে যেতে পারে, তাই স্ট্রেচিং করা খুব দরকারি। এর পাশাপাশি, ধীরে ধীরে পেশিতে শক্তি ফেরানোর জন্য কিছু ব্যায়াম করা উচিত। নিচে এই দুটি বিষয় সহজ ভাষায় আলোচনা করা হলো:
হাত ও পায়ের পেশি স্ট্রেচিং
স্ট্রেচিং মানে হলো শরীরের পেশিগুলোকে ধীরে ধীরে টেনে লম্বা করা। প্যারালাইসিসের পরে হাত ও পায়ের পেশিগুলোতে টান লাগতে পারে বা এগুলো ছোট হয়ে যেতে পারে। নিয়মিত স্ট্রেচিং করলে এই টান কমে এবং পেশিগুলো আবার নমনীয় হয়। এর ফলে হাত ও পা নাড়ানো সহজ হয় এবং ব্যথাও কমতে পারে।
হাত স্ট্রেচ করার জন্য, প্রথমে আপনার হাত সোজা করে ধরুন। এরপর ধীরে ধীরে আঙুলগুলো পেছনের দিকে টানুন, যতক্ষণ না আপনি আপনার হাতের সামনের দিকে হালকা টান অনুভব করেন। কিছুক্ষণ ধরে রাখুন এবং তারপর ছেড়ে দিন। একইভাবে, আপনার কবজি উপরের দিকে এবং নিচের দিকে ধীরে ধীরে বাঁকান। পায়ের জন্য, চিৎ হয়ে শুয়ে এক পা ভাঁজ করে ধরুন এবং অন্য পা সোজা রাখুন। এরপর সোজা পা-টির আঙুলগুলো আপনার দিকে টানুন, যতক্ষণ না আপনি পায়ের পেছনের দিকে টান অনুভব করেন। কিছুক্ষণ ধরে রেখে পা স্বাভাবিক করুন।
হালকা ওজন বা রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্তি বাড়ানো
যখন আপনার হাত ও পায়ের সামান্য শক্তি ফিরে আসে, তখন হালকা ওজন ব্যবহার করে বা রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে পেশিগুলোকে আরও শক্তিশালী করার ব্যায়াম শুরু করতে পারেন। তবে, এই ব্যায়ামগুলো অবশ্যই ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। তারা আপনার জন্য সঠিক ওজন এবং ব্যায়ামের নিয়ম ঠিক করে দেবেন।
হাতের শক্তি বাড়ানোর জন্য, খুব হালকা ওজনের কিছু ধরে ধীরে ধীরে উপরে-নিচে ওঠানো-নামানো যেতে পারে। রাবার ব্যান্ড ব্যবহার করে, এক প্রান্ত ধরে অন্য প্রান্ত হাত দিয়ে টেনে বিভিন্ন দিকে নাড়ানোও একটি ভালো ব্যায়াম। পায়ের জন্য, রাবার ব্যান্ড পায়ের পাতার সঙ্গে আটকে অন্য প্রান্ত হাত দিয়ে ধরে টানতে পারেন অথবা চেয়ারে বসে রাবার ব্যান্ড পায়ের তলায় রেখে দুই প্রান্ত ধরে পায়ের পাতা দিয়ে সামনের দিকে ধাক্কা দিতে পারেন। মনে রাখবেন, প্রথমে খুব হালকা ওজন বা কম tension-এর রাবার ব্যান্ড ব্যবহার করবেন এবং ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়াবেন।
ব্যালান্স ও সমন্বয় অনুশীলন
প্যারালাইসিসের পর শরীরের ভারসাম্য এবং হাত ও পায়ের মধ্যে সমন্বয় ফিরে পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই জন্য কিছু বিশেষ অনুশীলন করা প্রয়োজন। প্রথমে, বিছানায় বা চেয়ারে বসে কোমর সোজা রেখে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করতে পারেন। ধীরে ধীরে হাত ও পা নাড়িয়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার অনুশীলন করুন। এরপর, ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন এবং কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় থাকুন। যখন দাঁড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, তখন অল্প অল্প করে পা তুলে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করুন।
ধাপে ধাপে হাঁটার অনুশীলন শুরু করার জন্য প্রথমে অল্প দূরত্বে এবং ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করুন। দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন – খাওয়া, কাপড় পরা, ব্রাশ করা ইত্যাদি নিজের হাতে করার অনুশীলন সমন্বয় skill উন্নত করতে সহায়ক হবে। এই কাজগুলো প্রথমে ধীরে ধীরে এবং প্রয়োজনে কারো সাহায্য নিয়ে করতে পারেন।
ব্যায়ামের সময় করণীয় ও সতর্কতা
ব্যায়াম করার সময় কিছু বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোনো ব্যায়াম করার সময় ব্যথা অনুভব করেন, তবে সঙ্গে সঙ্গেই সেই ব্যায়াম বন্ধ রাখুন এবং আপনার ফিজিওথেরাপিস্টকে জানান। কখনোই তাড়াহুড়ো করে বা বেশি force দিয়ে ব্যায়াম করবেন না। ধীরে ধীরে এবং অল্প অল্প করে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সবসময় একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে এই ব্যায়ামগুলো করা উচিত। তারা আপনার শারীরিক অবস্থা বুঝে সঠিক ব্যায়াম নির্বাচন করবেন এবং প্রয়োজনে ব্যায়ামের নিয়ম পরিবর্তন করে দেবেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করলে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব।
উপসংহার
প্যারালাইসিসের পরে হাত ও পায়ের দুর্বলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে, আধুনিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে এই দুর্বলতা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নিয়মিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে ব্যায়াম করার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আশা করা উচিত নয়। ধৈর্য ধরে, নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে আপনার হাত ও পায়ের পেশিগুলোর শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
ফিজিওথেরাপি শুধু পেশিকে শক্তিশালী করাই নয়, এর পাশাপাশি হাত ও পায়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। হয়তো প্রথমে ছোট ছোট নড়াচড়া দিয়ে শুরু হবে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আপনি আগের মতো জিনিস ধরতে, নাড়াচাড়া করতে এবং হাঁটতে সক্ষম হবেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ধৈর্য ধরাটা খুবই জরুরি। অনেক সময় উন্নতি ধীরে ধীরে আসে, তাই হতাশ না হয়ে নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে থাকা। তারা আপনার শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করে সঠিক ব্যায়াম নির্বাচন করবেন এবং প্রয়োজনে আপনারProgress অনুসারে ব্যায়ামের নিয়ম পরিবর্তন করবেন। তাদের দেখানো পথে নিয়মিত ব্যায়াম করলে এবং নিজের মনোবল ধরে রাখলে, প্যারালাইসিসের কারণে হাত ও পায়ের কর্মক্ষমতা হারানোর ধাক্কা সামলে ওঠা এবং একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়া অবশ্যই সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনার চেষ্টা এবং ফিজিওথেরাপিস্টের সঠিক দিকনির্দেশনাই এই পথে আপনার প্রধান হাতিয়ার।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ নিউরোফিট