স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা দুই ধরনের হতে পারে: ইস্কেমিক স্ট্রোক, যেখানে রক্তনালী ব্লক হয়ে যায়, এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক, যেখানে রক্তনালী ফেটে রক্তপাত হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অতিরিক্ত ওজন, অলস জীবনযাপন, এবং রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য স্ট্রোকের প্রধান কারণ। এছাড়া মানসিক চাপ, মদ্যপান, এবং পারিবারিক ইতিহাসও ঝুঁকি বাড়ায়। কি কি কারণে স্ট্রোক হয় তা আজ আমরা বিস্তারিত জানবো।
স্ট্রোকের লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করা জরুরি। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্ট হওয়া, মুখ বেঁকে যাওয়া, হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, ভারসাম্য হারানো এবং হাঁটতে অসুবিধা হওয়া। এই লক্ষণগুলো চিহ্নিত করার জন্য FAST পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে: Face (মুখ বেঁকে যাওয়া), Arm (এক হাত তুলতে না পারা), Speech (কথা অস্পষ্ট হওয়া), এবং Time (তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা নেওয়া)। লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রোক প্রতিরোধে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম করা প্রয়োজন। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি স্থায়ী অক্ষমতা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি।
মিনি স্ট্রোকের বিশেষ কারণ ও লক্ষণ জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।
স্ট্রোকের প্রকারভেদ
১. ইস্কেমিক স্ট্রোক
ইস্কেমিক স্ট্রোক হলো স্ট্রোকের সবচেয়ে সাধারণ ধরন। এটি ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী কোনো রক্তনালী ব্লক হয়ে যায়। এই ব্লকেজের কারণে মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং পুষ্টি পায় না, যা মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি বা মৃত্যু ঘটাতে পারে।
ইস্কেমিক স্ট্রোক সাধারণত রক্তনালীর ব্লকেজের কারণে হয়, যা থ্রম্বোসিস (রক্ত জমাট বাঁধা) বা এম্বোলিজম (রক্তনালীতে জমাট বাঁধা অংশ ভেসে আসা) থেকে হতে পারে। উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, এবং ধূমপানের মতো জীবনযাত্রার অভ্যাস এই সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
২. হেমোরেজিক স্ট্রোক
হেমোরেজিক স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে যায় এবং রক্তপাত হয়। এই ধরনের স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম সাধারণ হলেও খুবই মারাত্মক হতে পারে।
হেমোরেজিক স্ট্রোক সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কারণে ঘটে। এছাড়াও, অস্বাভাবিক রক্তনালীর গঠন (যেমন আর্টেরিওভেনাস মালফর্মেশন) বা আঘাতজনিত কারণে এটি হতে পারে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন এবং ধূমপানও এই সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৩. ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (TIA)
ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক, যা সাধারণভাবে “মিনি স্ট্রোক” নামে পরিচিত, একটি অস্থায়ী সমস্যা। এটি ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এই অবস্থাটি সাধারণত কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে যায় এবং স্থায়ী ক্ষতি করে না।
যদিও TIA গুরুতর ক্ষতি করে না, এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্বাভাস হতে পারে। TIA হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং রক্তনালীর সমস্যার সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্দেশ করতে পারে।
কি কি কারণে স্ট্রোক হয়?
১. উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি। এটি রক্তনালীগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা তাদের স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে এই অতিরিক্ত চাপ রক্তনালীগুলোর ফাটার সম্ভাবনা বাড়ায়, বিশেষত মস্তিষ্কে, যা হেমোরেজিক স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের কারণে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে গেলে বা ব্লকেজ তৈরি হলে মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা এবং সঠিক চিকিৎসা এই ঝুঁকি কমাতে পারে।
২. ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস থাকলে শরীরের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। উচ্চ রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে রক্তনালীর দেয়ালকে দুর্বল করে তোলে এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় এবং ইস্কেমিক স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসের কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যা স্ট্রোকের আরেকটি বড় কারণ। নিয়মিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এই অবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
৩. উচ্চ কোলেস্টেরল
উচ্চ কোলেস্টেরল স্ট্রোকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রক্তনালীর দেয়ালে জমে প্লাক তৈরি করে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। এই প্লাক ধীরে ধীরে রক্তনালী সংকুচিত করে বা সম্পূর্ণভাবে ব্লক করতে পারে, ফলে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
রক্তনালীতে জমে থাকা কোলেস্টেরল প্লাক ভেঙে গেলে তা রক্তপ্রবাহে মিশে থ্রম্বোসিস (রক্ত জমাট বাঁধা) সৃষ্টি করতে পারে। এটি মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস উচ্চ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন
ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ধূমপানের কারণে রক্তনালী সংকুচিত হয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা রক্তনালীর ক্ষতি করে। একইভাবে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।
ধূমপানে থাকা নিকোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, অ্যালকোহল লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শরীরে চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ায়, যা উচ্চ কোলেস্টেরল এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এই অভ্যাস ত্যাগ করা বা নিয়ন্ত্রণ করা স্ট্রোক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
৫. স্থূলতা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা
স্থূলতা স্ট্রোকের একটি বড় ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। অতিরিক্ত ওজনের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থূলতা শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং রক্তনালীতে প্লাক জমার প্রবণতা বাড়ায়, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে ইস্কেমিক স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা জীবনযাত্রা স্থূলতার সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে আট ঘণ্টার বেশি সময় বসে কাটান এবং শারীরিক কার্যক্রম কম করেন, তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি সাত গুণ বেশি। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
৬. হৃদরোগ ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
হৃদরোগ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (AFib) স্ট্রোকের একটি বড় কারণ। AFib-এর ফলে হার্টে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা মস্তিষ্কে পৌঁছে রক্তনালী ব্লক করতে পারে এবং স্ট্রোক ঘটাতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ এবং AFib নিয়ন্ত্রণে রাখা স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত শারীরিক কার্যক্রম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ত্যাগ, এবং নির্ধারিত ওষুধ গ্রহণ হৃদরোগ ও AFib-এর ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
৭. বংশগত কারণ
পরিবারে কারো স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ব্যক্তির নিজের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটি মূলত কিছু জিনগত কারণ এবং পরিবারের অভ্যাসগত জীবনযাত্রার কারণে হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এবং সিকেল সেল ডিজিজের মতো জিনগত সমস্যাগুলোও এই ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যদিও বংশগত কারণগুলো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গ্রহণ করে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বংশগত স্ট্রোক ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর হতে পারে।
কম বয়সেও স্ট্রোক: কেন ঘটে এবং প্রতিরোধের উপায় জানতে আমাদের পোস্টটি পড়ুন।
কিভাবে বুঝবেন যে কেউ স্ট্রোক করেছে?
স্ট্রোক সাধারণত হঠাৎ করেই ঘটে এবং এর লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে স্ট্রোকের সাধারণ লক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. শরীরের একপাশ দুর্বল হয়ে যাওয়া বা অবশ হওয়াঃ স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো মুখ, হাত বা পায়ের হঠাৎ দুর্বলতা বা অবশ হয়ে যাওয়া। এটি সাধারণত শরীরের একপাশে ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি একটি হাত বা পা তুলতে না পারেন, অথবা মুখের একটি পাশ ঝুলে পড়ে, তবে এটি স্ট্রোকের ইঙ্গিত হতে পারে।
২. কথা বলার সমস্যা বা অস্পষ্টতাঃ স্ট্রোক হলে কথা বলার ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি অস্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন বা সঠিক শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে পারেন। অন্যদিকে, অন্যদের কথা বোঝার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হতে পারে।
৩. চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি হারানোঃ স্ট্রোকের ফলে হঠাৎ করে একটি বা উভয় চোখে ঝাপসা দেখা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, অথবা সম্পূর্ণ অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। এটি স্ট্রোকের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
৪. ভারসাম্য হারানো ও মাথা ঘোরাঃ স্ট্রোক হলে ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করে মাথা ঘোরা, হাঁটতে সমস্যা, বা সমন্বয় হারানোর মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এর সাথে কখনো কখনো বমি বা মাথাব্যথাও থাকতে পারে।
৫. তীব্র মাথাব্যথাঃ যদি কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা শুরু হয়, তবে এটি স্ট্রোকের ইঙ্গিত হতে পারে। এই ধরনের মাথাব্যথা প্রায়ই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সাথে সম্পর্কিত থাকে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
FAST টেস্ট পদ্ধতি
স্ট্রোক দ্রুত শনাক্ত করার জন্য FAST পদ্ধতি একটি সহজ এবং কার্যকর উপায়। এই পদ্ধতিটি স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, যা দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে FAST পদ্ধতিটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
- F (Face drooping): মুখ ঝুলে পড়াঃ স্ট্রোক হলে মুখের একপাশ ঝুলে পড়তে পারে। এটি পরীক্ষা করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসতে বলুন। যদি তার হাসি অসমান হয় বা মুখের একটি পাশ নিচের দিকে ঝুলে থাকে, তবে এটি স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে।
- A (Arm weakness): হাত দুর্বল হওয়াঃ স্ট্রোকের কারণে শরীরের একপাশ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এটি পরীক্ষা করতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দুই হাত তুলতে বলুন। যদি একটি হাত অন্যটির তুলনায় দুর্বল হয় বা নিচে নেমে যায়, তবে এটি স্ট্রোকের ইঙ্গিত হতে পারে।
- S (Speech difficulty): কথা বলার সমস্যাঃ স্ট্রোক হলে কথা বলার ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি সাধারণ বাক্য বলতে বলুন, যেমন “আমার নাম বলুন।” যদি তিনি অস্পষ্টভাবে কথা বলেন, শব্দ ভুল উচ্চারণ করেন, বা কথা বলতে সমস্যায় পড়েন, তবে এটি স্ট্রোকের আরেকটি লক্ষণ।
- T (Time to call emergency): জরুরি সেবা নেওয়ার সময়ঃ উপরের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত জরুরি সেবা নিন। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত বেশি মস্তিষ্কের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে।
FAST পদ্ধতি অনুসরণ করে স্ট্রোক শনাক্ত করা সহজ এবং জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলো দেখা মাত্রই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়
স্ট্রোক একটি জরুরি চিকিৎসাজনিত অবস্থা। আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষা এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি কমানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলোঃ
- ১. জরুরি সেবা নিনঃ যদি স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে ৯৯৯ বা নিকটস্থ হাসপাতালকে দ্রুত জানান। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত বেশি ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
- ২. আক্রান্ত ব্যক্তিকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করুনঃ আক্রান্ত ব্যক্তিকে আরামদায়ক অবস্থানে শুইয়ে দিন। মাথা সামান্য উঁচু করে রাখুন, যাতে রক্তপ্রবাহ সহজ হয়। তবে নিশ্চিত করুন যে তিনি নিরাপদ অবস্থায় আছেন এবং অতিরিক্ত নড়াচড়া করছেন না।
- ৩. খাওয়া বা পানি পান করাবেন নাঃ স্ট্রোকের কারণে গলায় সমস্যা হতে পারে, যা খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে পারে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো খাবার বা পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না।
- ৪. লক্ষণ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিনঃ যদি মুখ বা হাত একপাশে বাঁকা হয়ে যায় বা শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ দেবেন না।
স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়
স্ট্রোক প্রতিরোধে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত কার্যকর। নিচে স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১. নিয়মিত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন
উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, সিস্টোলিক রক্তচাপ প্রতি ১০ mmHg কমানোর মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক পরিশ্রমও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
২. ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন
ধূমপান রক্তনালী সংকুচিত করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং হৃদস্পন্দনের অনিয়ম সৃষ্টি করতে পারে। ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করলে শুধু স্ট্রোক নয়, অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিও কমানো সম্ভব।
৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
সুষম খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। কম চর্বিযুক্ত, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, যেমন ফলমূল, শাকসবজি, পূর্ণ শস্য, এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ মাছ খাওয়া মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী। লবণ গ্রহণ সীমিত রাখাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৪. প্রতিদিন ব্যায়াম করুন
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, কোলেস্টেরল কমায়, এবং স্থূলতা প্রতিরোধ করে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেমন দ্রুত হাঁটা বা সাইক্লিং। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
৫. ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করুন
ডায়াবেটিস এবং উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে, কোলেস্টেরল কমাতে সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং প্রয়োজনে স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপরিউক্ত অভ্যাসগুলো অনুসরণ করে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গ্রহণ করলে শুধু স্ট্রোক নয়, অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগ থেকেও মুক্ত থাকা যায়।
কিছু কথা
স্ট্রোক একটি গুরুতর এবং জীবনহানিকর সমস্যা হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক জীবনযাত্রা অনুসরণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস পরিহার করে স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করার মাধ্যমে আপনি সুস্থ থাকতে পারেন। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক পরিশ্রম স্ট্রোক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্ট্রোকের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুখের একপাশ ঝুলে পড়া, হাত বা পায়ের দুর্বলতা, কথা বলার সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি হারানো, বা ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। FAST পদ্ধতি অনুসরণ করে স্ট্রোক দ্রুত শনাক্ত করা যায়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি কমানো এবং জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়।
সুস্থ জীবনযাত্রা শুধু স্ট্রোক নয়, আরও অনেক দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আপনি নিজের এবং পরিবারের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারেন। স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। মনে রাখবেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া মানেই জীবন বাঁচানো।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ নিউরোফিট
সাধারণ জিজ্ঞাসা
১. স্ট্রোক হলে কি পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব?
স্ট্রোকের পর পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব, তবে এটি নির্ভর করে স্ট্রোকের ধরন, এর তীব্রতা, এবং চিকিৎসা পাওয়ার সময়ের ওপর। যদি দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া হয়, তাহলে অনেক রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসার মধ্যে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করা, পুনর্বাসন থেরাপি, এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, যা পুনর্বাসনের মাধ্যমে উন্নত করা যায়।
২. কি ধরনের খাবার স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক?
স্ট্রোক প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলমূল, শাকসবজি, পূর্ণ শস্য, এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ মাছ স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক। কম লবণযুক্ত খাবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও, চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী।
৩. স্ট্রোকের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
স্ট্রোকের চিকিৎসা মূলত এর কারণ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। ইস্কেমিক স্ট্রোকে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করতে থ্রম্বোলাইটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা জমাট বাঁধা রক্ত সরিয়ে দেয়। হেমোরেজিক স্ট্রোকে রক্তপাত বন্ধ করতে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া পুনর্বাসন থেরাপি, যেমন ফিজিওথেরাপি এবং স্পিচ থেরাপি, রোগীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
৪. তরুণদের কি স্ট্রোক হতে পারে?
হ্যাঁ, তরুণদেরও স্ট্রোক হতে পারে। যদিও এটি তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, যেমন ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া জেনেটিক কারণ বা জন্মগত হৃদরোগ তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. স্ট্রোক প্রতিরোধের সহজ উপায় কী?
স্ট্রোক প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যায়াম করা সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এবং রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আপনি স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারেন। পাশাপাশি মানসিক চাপ কমানোও স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।