স্ট্রোক হলে আমাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে অথবা রক্তক্ষরণ হতে পারে। মস্তিষ্কের একেকটি অংশ শরীরের একেক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের সেই অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা আমাদের হাত-পা ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই প্যারালাইসিস দেখা দেয়। আমাদের এই পোস্টে স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস কিভাবে হয় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আমাদের মস্তিষ্ক শরীরের ডান পাশকে নিয়ন্ত্রণ করে আর বাম পাশ শরীরের বাম পাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্ট্রোক যদি মস্তিষ্কের ডান দিকে হয়, তাহলে শরীরের বাম দিকে প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার স্ট্রোক মস্তিষ্কের বাম দিকে হলে শরীরের ডান দিকে প্যারালাইসিস হতে পারে।
সাধারণত স্ট্রোকের কারণে শরীরের এক পাশ অবশ বা দুর্বল হয়ে যাওয়াটা বেশি দেখা যায়। একে হেমিপ্লেজিয়া বলা হয়। এর মানে হলো শরীরের হয় ডান হাত ও ডান পা, অথবা বাম হাত ও বাম পা দুর্বল হয়ে যায় বা একেবারেই নড়াচড়া করতে পারে না। তবে স্ট্রোকের তীব্রতা ও মস্তিষ্কের কতটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে প্যারালাইসিসের ধরন ও মাত্রা ভিন্ন হতে পারে।
প্যারালাইসিস রোগীর হাত-পায়ে শক্তি ফিরে পাবার জন্য বিশেষ ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।
কোন ধরনের স্ট্রোক বেশি প্যারালাইসিস ঘটায়?
ইস্কেমিক স্ট্রোক হলো সেই ধরনের স্ট্রোক, যেখানে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, যেমন রক্ত জমাট বেঁধে। এই ধরনের স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং প্যারালাইসিসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি। যখন মস্তিষ্কের কোষে রক্ত পৌঁছানো বন্ধ হয়ে যায়, তখন অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে কোষগুলো দ্রুত মারা যেতে শুরু করে। মস্তিষ্কের যে অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার ওপর নির্ভর করে শরীরের কোন অংশে প্যারালাইসিস হবে। যেহেতু ইস্কেমিক স্ট্রোকের সংখ্যাই বেশি, তাই এটিই মূলত বেশি সংখ্যক প্যারালাইসিসের জন্য দায়ী।
তবে, ইস্কেমিক স্ট্রোকের ফলে প্যারালাইসিস কতটা তীব্র হবে বা কতদিন স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করে রক্তনালী কতটা দ্রুত বন্ধ হয়েছে এবং মস্তিষ্কের কতটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপর। অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় এবং প্যারালাইসিসও পুরোপুরি সেরে যেতে পারে অথবা তার তীব্রতা কমানো যায়।
হেমোরেজিক স্ট্রোকঃ দ্রুত ও তীব্র প্যারালাইসিস ঘটাতে পারে
হেমোরেজিক স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে যায় এবং রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এই রক্তক্ষরণ মস্তিষ্কের কোষগুলোর ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করে এবং তাদের ক্ষতি করে। ইস্কেমিক স্ট্রোকের তুলনায় হেমোরেজিক স্ট্রোক কম দেখা গেলেও, এটি খুব দ্রুত এবং তীব্র প্যারালাইসিস ঘটাতে পারে। রক্তক্ষরণের পরিমাণ ও স্থান ভেদে প্যারালাইসিসের তীব্রতা ভিন্ন হতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি জীবন হানিকরও হতে পারে।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস এতটাই দ্রুত হতে পারে যে, রোগী হয়তো হঠাৎ করেই শরীরের কোনো অংশ নাড়াতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এই ধরনের স্ট্রোকে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ রক্তক্ষরণ বন্ধ করা এবং মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমানোর মাধ্যমেই রোগীর জীবন রক্ষা করা এবং প্যারালাইসিসের তীব্রতা কমানো সম্ভব।
প্যারালাইসিসের লক্ষণ
শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া
প্যারালাইসিসের একটা বড় লক্ষণ হলো শরীরের হয় ডান দিক, না হয় বাম দিক দুর্বল বা অসাড় হয়ে যাওয়া। হঠাৎ করে মনে হতে পারে যেন হাত বা পায়ে জোর নেই, অথবা সেগুলো совсем নাড়ানো যাচ্ছে না। অনেক সময় এমনও হয় যে, শরীরের সেই অংশে কোনো ছোঁয়া বা অনুভূতিও টের পাওয়া যায় না।
ধরুন, স্ট্রোকের কারণে যদি মস্তিষ্কের বাঁ দিকের অংশে আঘাত লাগে, তাহলে আপনার শরীরের ডান দিকের হাত ও পা দুর্বল হয়ে যেতে পারে বা অবশ হয়ে যেতে পারে। একইভাবে, মস্তিষ্কের ডান দিকে সমস্যা হলে বাঁ দিকের হাত ও পায়ে একই রকম অনুভূতি হতে পারে। এই লক্ষণ দেখলে একদম দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
কথা বলা, চলাফেরা বা মুখের স্বাভাবিকতা হারানো
প্যারালাইসিসের কারণে শুধু হাত-পাই নয়, কথা বলা এবং মুখের ভাবভঙ্গিতেও সমস্যা হতে পারে। হঠাৎ করে কথা জড়িয়ে যেতে পারে, অথবা রোগী হয়তো কিছু বলতেই পারছেন না। এমনকি সহজ কথাও বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।
মুখের ক্ষেত্রে, প্যারালাইসিসের জন্য মুখ বেঁকে যেতে পারে, মুখ থেকে লালা পড়তে পারে, অথবা হাসতে বা অন্য কোনো অভিব্যক্তি দেখাতে সমস্যা হতে পারে। চলাফেরার ক্ষেত্রে, ভারসাম্য রক্ষার অভাব হতে পারে, পা টলমল করতে পারে বা হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে। এই লক্ষণগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত ডাক্তারের নজরে আনা দরকার।
গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।
স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস কিভাবে হয়? ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ও প্রতিরোধ
ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ও প্রতিরোধ
কিছু শারীরিক সমস্যা ও অভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, আর স্ট্রোক হলে প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ। যাদের ব্লাড প্রেসার বেশি থাকে, তাদের মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলোতে চাপ বেশি পড়ে, যা ফেটে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিসও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এটা রক্তনালীগুলোকে সরু করে ফেলে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়, ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
এছাড়াও, হৃদরোগ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং স্থূলতাও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই যাদের এই সমস্যাগুলো আছে, তাদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো উচিত।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ
স্ট্রোক এবং এর ফলে প্যারালাইসিসের ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত সুষম খাবার খাওয়া, যেখানে ফল, সবজি এবং ফাইবার বেশি থাকে এবং ফ্যাট ও কোলেস্টেরল কম থাকে। নিয়মিত ব্যায়াম করাও খুব জরুরি, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমায়।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা উচিত। পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করাও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো ঝুঁকি আছে, তাদের নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া উচিত। একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক কমাতে পারে এবং প্যারালাইসিস থেকে রক্ষা করতে পারে।
শেষ কথা
স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস মূলত মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোর ক্ষতির ফলে হয়, যা আমাদের শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়া (ইস্কেমিক স্ট্রোক) অথবা রক্তক্ষরণের (হেমোরেজিক স্ট্রোক) মাধ্যমে মস্তিষ্কের এই অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্যারালাইসিস দেখা দিতে পারে।
মস্তিষ্কের ডান দিক শরীরের বাম দিক এবং বাম দিক শরীরের ডান দিক নিয়ন্ত্রণ করে। তাই স্ট্রোক মস্তিষ্কের যে পাশে আঘাত হানে, শরীরের বিপরীত পাশে প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া, যাকে হেমিপ্লেজিয়া বলা হয়, স্ট্রোকের একটি সাধারণ পরিণতি।
তবে, প্যারালাইসিসের তীব্রতা এবং শরীরের কতটা অংশ আক্রান্ত হবে, তা স্ট্রোকের ধরন ও মস্তিষ্কের কতটা এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ওপর নির্ভরশীল। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে প্যারালাইসিসের প্রভাব কমানো এবং রোগীর পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ নিউরোফিট