স্ট্রোক বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি রোগ । ব্রেইনের রক্ত সরবরাহ কোন কারনে বিঘ্নিত হলে রক্তের অভাবে কিছু ব্রেইন টিস্যু মারা যায়, এটাই হল স্ট্রোক । বিশেষ করে রক্ত নালী ব্লক হয়ে কিংবা রক্তনালী ছিঁড়ে ব্রেইনের এই রক্ত সরবরাহ বিঘ্ন হয় । স্ট্রোক হয় ব্রেইনে ।
স্ট্রোকের প্রকারভেদঃ
সিডিসি (CDC= Center for Disease Control and prevention) এর মত অনুযায়ী স্ট্রোক তিন প্রকার ধরনের-
১। ইশকিমিক স্ট্রোক ( Ischemic stroke)ঃ মস্তিষ্কের রক্তনালীর ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে (blood Clot) রক্ত সরবরাহ বিঘ্ন ঘটালে কিছু ব্রেইন টিস্যু মারা যায় , এটাই ইশকেমিক স্ট্রোক। ৮৫%স্ট্রোকই ইশকেমিক স্ট্রোক । উচ্চরক্তচাপ ইশকেমিক স্ট্রোকের বড় কারণ ।
২। হেমোরেজিক স্ট্রোক ( Hemorrhagic Stroke)ঃ মস্তিষ্কের ভিতরে কোন রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে হেমোরেজিক স্ট্রোক হয় । এই ধরনের স্ট্রোকে তিন মাসের মধ্যে মৃত্যু ঝুকি অনেক অনেক বেশি ।
৩। খুব ছোট স্ট্রোক ( Mini Stroke or Transient Ischemic Attack- TIA)ঃ মস্তিষ্কের রক্তনালীতে অস্থায়ীভাবে অল্প কিছু সময়ের জন্য রক্ত সরবরাহ বিঘ্ন হলে এই ধরনের স্ট্রোক হয় ! যেটা দ্রুতই আবার ভাল হয়ে যায়।
মিনি স্ট্রোক (TIA) হল বড় ধরনের স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষন । ছোট স্ট্রোক (TIA) হওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ৫%, এক সপ্তাহের মধ্যে ৮%, এক মাসের মধ্যে ১২% এবং তিনমাসের মধ্যে ১৭% মানুষ বড় ধরনের স্ট্রোক করে । তাই এই ছোট স্ট্রোককে কোন ভাবেই অবহেলা করা উচিত না । আপনার নিকটবর্তী চিকিৎসক বা হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত । বিশেষ করে উচ্চরক্তচাপ সহ স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রন করা উচিত । নিয়মিত এক্সারসাইজ এবং সঠিক খাবারের মাধ্যমে স্ট্রোক নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব ।
এছাড়া এক বার স্ট্রোক হলে পরবর্তীতে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুকি ৪ গুন বেড়ে যায় ।
স্ট্রোক কেন হয় ?
একজন মানুষের বিভিন্ন কারনে স্ট্রোক হতে পারে,মানুষের খাদ্যাভ্যাস,জীবন যাত্রার মান, পরিবেশের উপর নির্ভর করে।
অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এর মধ্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ হলো-
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মানুষ তাদের নিজেদের কি কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত , দৈনিক শারীরিক ব্যায়াম করা, রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রনে রাখা,বা রেগুলার চেক করা এই সব নিয়ে সচেতন নয়,
উচ্চ রক্তচাপের কারনে স্ট্রোক হয়ে থাকে,প্রতিটি মানুষের উচিত তাদের ব্লাড প্রেশার কেমন আছে সেটা নিয়ে সচেতন থাকা, না হয় হঠাত রক্তচাপ বেড়ে স্ট্রোক হতে পারে।কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে কোলেষ্টেরলের পরিমান বেড়ে যায়,যেটার ফলে পরবর্তীতে স্ট্রোক হতে পারে। কোন কোন সময় দেখা যায় ধূমপানের কারনেও স্ট্রোক হতে পারে। পরিবারের কারো স্ট্রোক হয়েছে এমন ইতিহাস থাকলে তাদের সন্তানদেরও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই ছাড়াও হার্টের সমস্যা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন,রক্তজমাট বাঁধা,ক্যান্সারের কারনেও স্ট্রোক হতে পারে।
এই সব কারন ছাড়াও আরো কিছু কারন রয়েছে সেগুলোর কারনেও স্ট্রোক হতে পারে
যেমন- হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া,জন্মগত রক্তনালির সমস্যা,জন্মগত এনজাইমের সমস্যা,মেটাবলিক সমস্যা ইত্যাদি
আমরা অনেকেই মনে করি যে শুধু বয়স্কদের স্ট্রোক হয় আসলে বিভিন্ন কারনে,বিভিন্ন সময় তরুনদেরও স্ট্রোক হতে পারে।
স্ট্রোকের লক্ষন সমুহঃ
- হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া
- শরীরের কোন অংশ ধীরে ধীরে দুর্বল বা অবস হয়ে পড়া।
- মুখ এক দিকে বেঁকে যাওয়া
- মুখ থেকে খাবার ও পানি পড়ে যাওয়া
- আচরনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।
- চিনতে না পারা।
- উল্টাপাল্টা কথা বলা।
- অকারনে বিরক্ত হওয়া।
- অনেক চুপচাপ হয়ে যাওয়া।
- আরো অনেক কারণ থাকতে পারে।
স্ট্রোকের সাথে সাথে কি করবেন?
অনেকের ধারনা স্ট্রোক হার্টে হয় , আসলে স্ট্রোক হয় ব্রেইনে । হার্টে হলে বলে হার্ট এট্যাক বলে। ব্রেইনে কোন কারণে রক্ত সরবরাহ বিঘ্ন হলে রক্তের অভাবে কিছু ব্রেইন টিস্যূ মারা যায় , এটাই স্ট্রোক । স্ট্রোকের সাথে সাথে বুঝতে পারলে জীবন রক্ষা সম্ভব । অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সেটা বুঝতে পারি না , ফলে হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে, যায় ফলে স্ট্রোকের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যাও আরো বেড়ে যায় ।
প্রথমত আপনাকে FAST শব্দটি দ্বারা স্ট্রোক হয়েছে কিনা নিশ্চিত হোন ।
F= Face (মুখ ), স্ট্রোকের সাথে সাথে মুখ বেঁকে যায় ।
A= Arm (হাত ) শরীরের যে কোন এক পাশের হাত পা প্যারালাইসিস হয়ে যায়
S= Speech ( কথা) কথা বলতে সমস্যা হয় ।
T= Time to call 999 for Ambulance ।
আপনি FAST শব্দটি দ্বারা বুঝতে পারলেন, আপনার নিকটজন স্ট্রোক করছ এবং অ্যাম্বুলেন্স কল দিয়েছেন । হাসপাতালে নিয়ে যাবেন ।
কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত এখন আপনি কি করবেন ?
১। রোগীর যদি জ্ঞান থাকে তাহলে এক পাশ করে শুইয়ে দিন । প্যারালাইসিস অংশ উপরে থাকবে, সুস্থ্য অংশ বিছানার সাথে নিচে থাকবে । একটি উচু বালিশ বা দুটো বালিশ দিয়ে মাথা উপরের দিকে রাখবেন । অবশ্যই মাথা এবং প্যারালাইসিস হাতকে সাপোর্ট দিয়ে রাখবেন । লক্ষ্য রাখবেন, প্যারালাইসিস হাত যেন না ঝুলে থাকে ।
২। কোনভাবেই প্যারালাইসিস হাতকে নিয়ে টানাটানি করবেন না । এতে করে পরবর্তীতে সোল্ডার সাবলাক্সেশন হয়ে যেতে পারে । বেশির ভাগক্ষেত্রেই এই ঘটনা হয়ে থাকে । ফলে ওই রোগী পরবর্তীতে ভাল করা কঠিন হয়ে যায় । বিশেষ করে হাতের ফাংশন বাধাগ্রস্ত হয় ।
৩। স্ট্রোক করা রোগীকে কোন কিছু খেতে দিবেন না, এমন কি পান করতেও দিবেন না ।
৪। শরীরে কোন টাইট কাপড় পরা থাকলে খুলে দিবেন, যাতে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে রোগীর কোন অসুবিধা না হয় ।
৫। রোগী যদি অজ্ঞান থাকে, তাহলে ভাল পাশে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস এবং পালস চেক করুন । শ্বাস প্রশ্বাস এবং পালস ওকে থাকলে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করুন ।
৬। আরও যদি শ্বাস প্রশ্বাস এবং পালস পাওয়া না যায় সিপিআর (CPR- Cardiopulmonary Resuscitation ) শুরু করতে পারেন । যদি আপনার জানা থাকে । আর জানা না থাকলে আপনার নিকটবর্তী হেলথ কেয়ার প্রফেশনালের সহযোগিতা নিতে পারেন ।
স্ট্রোক প্রতিরোধের কয়েকটি টি উপায়ঃ
১! উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখুন : স্ট্রোকের প্রধান শত্রু উচ্চ রক্তচাপ!!! তাই যেকোন ভাবে একে ম্যানেজ করুন। উচ্চরক্তচাপের কারন বের করে চিকিৎসা নিন,স্ট্রোক থেকে দূরে থাকুক।
২! ওজন কমান: যেইভাবে ফাস্টফুডের দোকান হচ্ছে। সবাই খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে। বাংগালির ভাগ্য আসলেই খারাপ, বাংগালি এক সময়ে না খেয়ে মরত, এখনখেয়ে মরবে ।
৩! নিয়মিত ব্যায়াম করুন : যারা অসুস্থ এবং অতিরিক্ত মোটা তারা অবশ্যই ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে ব্যায়াম করবেন।। সম্প্রতি ল্যানসেটের গবেষনায় স্ট্রোক প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় ফিজিক্যাল এক্টিভিটির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ।
৪! ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখুন : অনেকে বলে থাকেন ডায়াবেটিস হল সকল রোগের জননী। তাই স্ট্রোক থেকে বাঁচতে হলে ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
৫! ধূমপান পরিহার করুন: ধুমপানের কারনে রক্তে ক্লটিং তৈরি ত্বরান্বিত হয়!! ফলে স্ট্রোকের ঝুকি বেড়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশ সবচেয়ে মৃত্যুর কারন স্ট্রোক, এবং সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধিতার কারন স্ট্রোক!!! সারা পৃথিবীতে প্রতি ৬ জনে ১ জন স্ট্রোক করে!
আসুন স্ট্রোক প্রতিরোধ করি, স্ট্রোক থেকে নিজে বাঁচি এবং অন্যকে রক্ষা করি!