মটর নিউরন ডিজিজঃ কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

মটর নিউরন ডিজিজ কি? কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) কী?

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) একটি গুরুতর স্নায়বিক রোগ। এটি মস্তিষ্কে ও মেরুদণ্ডে থাকা মটর নিউরন নামে পরিচিত স্নায়ু কোষগুলোকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই কোষগুলো আমাদের ইচ্ছামতো পেশী নাড়াচাড়া করতে সাহায্য করে। MND হলে এই মটর নিউরনগুলো সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে যায় এবং মরে যায়। ফলে আমাদের পেশীগুলো শক্তি হারাতে থাকে, ক্ষয় হতে শুরু করে। এর কারণে কথা বলা, খাবার গিলতে এমনকি শ্বাস নিতেও সমস্যা হতে পারে, এবং শেষ পর্যন্ত শরীর অসাড় হয়ে যেতে পারে। এই রোগকে অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (ALS) বা লু গেরিগ’স ডিজিজ নামেও ডাকা হয়।

MND আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং সময়ের সাথে সাথে খারাপ হতে থাকে। প্রাথমিকভাবে হাত-পায়ে দুর্বলতা, পেশী টান বা কাঁপুনি দেখা যেতে পারে। যেহেতু এই রোগ পেশী নড়াচড়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, তাই আক্রান্ত ব্যক্তিরা দৈনন্দিন কাজ যেমন হাঁটাচলা, পোশাক পরা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি করতেও সমস্যার সম্মুখীন হন। রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে রোগীর পক্ষে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

বর্তমানে MND-এর কোনো নিরাময় নেই, তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রোগের লক্ষণগুলো কমাতে এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি এবং কিছু ঔষধ ব্যবহার করে রোগীরা তাদের দৈনন্দিন কাজগুলো চালিয়ে যেতে পারেন এবং কষ্ট কিছুটা কমাতে পারেন। এই রোগের চিকিৎসায় ডাক্তার, নার্স এবং থেরাপিস্টদের একটি সম্মিলিত দল কাজ করে।

ডিমেনশিয়া বিষয়ক তথ্য জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

মটর নিউরন ডিজিজ কেন হয় বা এর কারণ

মটর নিউরন ডিজিজ কেন হয় বা এর কারণ

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) কেন হয়, তা বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানতে পারেননি। এটিকে একটি খুবই জটিল রোগ হিসেবে দেখা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এটি বংশগত কিছু কারণ, পরিবেশ থেকে আসা কিছু প্রভাব এবং আমাদের শরীরের ভেতরের কিছু জৈব রাসায়নিক গণ্ডগোলের সম্মিলিত ফল হতে পারে। ঠিক কী কারণে এই রোগ হয়, তা খুঁজে বের করতে সারা বিশ্বে এখনও অনেক গবেষণা চলছে।

বংশগত কারণ

MND-এর কিছু ক্ষেত্রে বংশগত যোগসূত্র দেখা যায়। এর মানে হলো, যদি পরিবারের কোনো সদস্যের এই রোগ থাকে, তাহলে অন্য সদস্যদেরও এটি হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দিষ্ট জিনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন, যা MND হওয়ার পেছনে কাজ করতে পারে। যেমন, কিছু জিন আছে, যাদের নাম C9orf72, SOD1, TARDBP, এবং FUS। এই জিনগুলো আমাদের স্নায়ু কোষের ঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করে। যদি এই জিনগুলোতে কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে প্রোটিন তৈরি ঠিকমতো হয় না, যার ফলে স্নায়ু কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে মজার বিষয় হলো, বেশিরভাগ MND রোগীর ক্ষেত্রেই পরিবারে এই রোগের কোনো ইতিহাস থাকে না, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় “স্পোরাডিক MND” বলা হয়।

স্নায়ুতন্ত্রের প্রদাহ

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, MND রোগীদের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের স্নায়ুতন্ত্রে প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া (নিউরোইনফ্লেমেশন) থাকতে পারে। এর মানে হলো, স্নায়ু কোষগুলোর আশেপাশে কিছু প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষ জমা হয় এবং তারা এমন কিছু ক্ষতিকারক উপাদান তৈরি করে যা মটর নিউরনগুলোকে নষ্ট করে দিতে পারে। এই প্রদাহ হয়তো কোনো সংক্রমণের কারণে হতে পারে, অথবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভুল প্রতিক্রিয়ার (অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া) কারণেও হতে পারে। অর্থাৎ, শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুল করে সুস্থ স্নায়ু কোষগুলোকেই আক্রমণ করে বসে।

অতিরিক্ত চাপ (অক্সিডেটিভ স্ট্রেস)

আমাদের মটর নিউরনগুলো অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের প্রতি খুব সংবেদনশীল হতে পারে। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে আমাদের শরীরে “ফ্রি র্যাডিকেল” নামে কিছু অস্থির অণু বেড়ে যায়। এই ফ্রি র্যাডিকেলগুলো কোষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন ডিএনএ, প্রোটিন এবং চর্বিকে (লিপিড) নষ্ট করে দেয়। যখন মটর নিউরনে এই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়, তখন তাদের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা মরে যায়, যা MND এর কারণ হতে পারে।

অস্বাভাবিক প্রোটিন জমা হওয়া

MND-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, মটর নিউরনের ভেতরে অস্বাভাবিক প্রোটিনগুলো জমাট বেঁধে যায় বা স্তূপ তৈরি করে। সাধারণত, আমাদের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা অপ্রয়োজনীয় প্রোটিনগুলোকে শরীর থেকে সরিয়ে ফেলে। কিন্তু MND-তে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে TDP-43 এবং FUS এর মতো কিছু প্রোটিন অস্বাভাবিকভাবে জমা হতে শুরু করে। এই জমাট বাঁধা প্রোটিনগুলো নিউরনের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা দেয় এবং তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও এক নিউরন থেকে অন্য নিউরনে বার্তা পাঠানোর প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয়, যা নিউরনের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

পরিবেশের প্রভাব এবং অন্যান্য ঝুঁকি

এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো পরিবেশগত কারণকে সরাসরি MND সৃষ্টির জন্য দায়ী করা যায়নি। তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভারী ধাতু, কীটনাশক বা কিছু বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা এবং ভাইরাসের সংক্রমণকে সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও, পুরুষদের মধ্যে MND হওয়ার ঝুঁকি মহিলাদের তুলনায় কিছুটা বেশি। সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের পর এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়, যদিও এটি যেকোনো বয়সের মানুষেরই হতে পারে। ধূমপান এবং মাথায় আঘাত লাগার বিষয়টিও কিছু গবেষণায় সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

মটর নিউরন ডিজিজ এর লক্ষণ

মটর নিউরন ডিজিজ এর লক্ষণ

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) একটি প্রগতিশীল রোগ, যার লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে এবং রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে উপসর্গের তীব্রতাও পরিবর্তিত হয়। MND প্রধানত পেশী নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু কোষগুলোকে প্রভাবিত করে, তাই এর বেশিরভাগ লক্ষণই পেশী সম্পর্কিত।

প্রধান লক্ষণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:

  • পেশী দুর্বলতা: এটি MND-এর সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি। এই দুর্বলতা শরীরের যেকোনো অংশে শুরু হতে পারে, তবে সাধারণত হাত, পা, মুখ এবং জিহ্বায় এটি বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা দৈনন্দিন কাজ যেমন কোনো কিছু ওঠানো, সিঁড়ি ভাঙা, লিখতে বা বোতাম লাগাতে অসুবিধা অনুভব করতে পারেন। পেশী দুর্বলতার কারণে মাংসপেশী শুকিয়ে (মাসল ওয়েস্টিং) যেতে পারে।
  • পেশীতে খিঁচুনি, ব্যথা এবং টুইচ (অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া): MND আক্রান্তদের প্রায়শই পেশীতে ক্র্যাম্প বা খিঁচুনি হয়, যা বেশ বেদনাদায়ক হতে পারে। এছাড়াও, পেশীতে ফ্যাসিকুলেশন (fasciculations) দেখা যায়, যা ত্বকের নিচে পেশীর ক্ষুদ্র, অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া বা কাঁপুনি। এটি বাইরে থেকে দেখা যেতে পারে এবং রোগী নিজে অনুভব করতে পারেন।
  • কথা বলতে অসুবিধা (ডিসার্থ্রিয়া): যখন মুখ, জিহ্বা এবং গলার পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, তখন কথা বলা কঠিন হয়ে পড়ে। রোগীর কথা জড়িয়ে যায় বা ঝাপসা শোনায় (slurred speech), যাকে ডিসার্থ্রিয়া বলা হয়। ধীরে ধীরে কথা বলার গতি কমে যায় এবং পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়।
  • গিলতে সমস্যা (ডিসফ্যাজিয়া): এটি MND-এর একটি গুরুতর লক্ষণ, যা খাদ্য ও তরল গিলতে অসুবিধা সৃষ্টি করে। দুর্বল পেশীর কারণে খাবার গলায় আটকে যেতে পারে বা শ্বাসনালীতে চলে যেতে পারে, যার ফলে কাশি হয় বা শ্বাসরোধের ঝুঁকি বাড়ে। এর কারণে রোগীর পুষ্টিহীনতা এবং ওজন কমার ঝুঁকিও থাকে।
  • হাঁটতে অসুবিধা, হোঁচট খাওয়া: পায়ের পেশী দুর্বল হওয়ার কারণে হাঁটার সময় সমস্যা হয়। রোগী ভারসাম্য হারাতে পারেন এবং প্রায়শই হোঁচট খান বা পড়ে যান। পায়ের পাতা তুলতে অসুবিধা হতে পারে, যাকে “ফুট ড্রপ” বলা হয়, যার কারণে পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়।
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া (শ্বাসযন্ত্রের দুর্বলতা): যখন ডায়াফ্রাম এবং বুকের অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বিশেষ করে শুয়ে থাকা অবস্থায় বা রাতে। রোগী শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যেতে পারে। এটি রোগের একটি গুরুতর পর্যায় নির্দেশ করে।
  • অপ্রত্যাশিত মানসিক প্রতিক্রিয়া: কিছু MND রোগীর মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণহীনতা (emotional lability) দেখা যায়, যেখানে তারা কোনো কারণ ছাড়াই অপ্রত্যাশিতভাবে হাসতে বা কাঁদতে শুরু করেন। এটি মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে হয় এবং রোগীর ইচ্ছাধীন থাকে না।
  • ওজন কমে যাওয়া: গিলতে অসুবিধা এবং পেশী ক্ষয়ের কারণে রোগীদের ওজন কমে যায়। পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করতে না পারা এবং শরীরের অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় হওয়ার কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়।

মটর নিউরন ডিজিজ এর প্রতিকার ও চিকিৎসা

মটর নিউরন ডিজিজ এর প্রতিকার ও চিকিৎসা

বর্তমানে মটর নিউরন ডিজিজ (MND) সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করার কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো রোগের লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। বিভিন্ন ধরণের থেরাপি এবং সহায়ক ব্যবস্থা ব্যবহার করে রোগীদের দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সাহায্য করা হয়। চিকিৎসার পরিকল্পনা সাধারণত রোগীর নির্দিষ্ট লক্ষণ এবং রোগের অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়, যেখানে একটি বহু-শাখা পদ্ধতির (multidisciplinary approach) ওপর জোর দেওয়া হয়।

MND-এর চিকিৎসায় বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়:

  • ফিজিওথেরাপি: পেশী দুর্বলতা MND-এর একটি প্রধান লক্ষণ। ফিজিওথেরাপি পেশীগুলোকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী রাখতে, পেশী টান কমাতে এবং জয়েন্টের নড়াচড়া স্বাভাবিক রাখতে অত্যন্ত সহায়ক। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম এবং স্ট্রেচিং শেখান যা পেশীর কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে রোগী দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন।

সহায়ক চিকিৎসা

    • স্পিচ থেরাপি (কথা বলার চিকিৎসা): যখন কথা বলার পেশী দুর্বল হয়ে যায়, তখন স্পিচ থেরাপিস্ট কথা বলার দক্ষতা উন্নত করতে এবং যোগাযোগের বিকল্প পদ্ধতি শেখাতে সাহায্য করেন। এর মধ্যে ভয়েস অ্যামপ্লিফায়ার বা কমিউনিকেশন ডিভাইস ব্যবহার করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
    • গিলতে সহায়তার জন্য খাদ্য পরিবর্তন ও পুষ্টি: গিলতে অসুবিধা (ডিসফ্যাজিয়া) হলে খাদ্য বিশেষজ্ঞ খাদ্য পরিবর্তন, যেমন নরম বা তরল খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন। যদি রোগীর গিলতে খুব বেশি সমস্যা হয় এবং পুষ্টির অভাব দেখা দেয়, তাহলে নলের মাধ্যমে খাবার (যেমন PEG টিউব) প্রদানের প্রয়োজন হতে পারে।
    • শ্বাসযন্ত্রের সহায়তা: শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার পেশীগুলো দুর্বল হয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই অবস্থায়, নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন (NIV) বা প্রয়োজনে অন্যান্য ভেন্টিলেশন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীকে শ্বাস নিতে সাহায্য করা হয়। শ্বাসকষ্ট তীব্র হলে বা আকস্মিক হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এছাড়াও, রোগের অগ্রগতি ধীর করতে কিছু ঔষধ যেমন রিলুজোল (Riluzole) এবং এডারাভোন (Edaravone) ব্যবহার করা হয়, যদিও এগুলো রোগ নিরাময় করে না। ব্যথা কমানো, পেশী খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ এবং বিষণ্ণতা মোকাবেলার জন্যও নির্দিষ্ট ঔষধ দেওয়া হতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা এবং সামাজিক সহায়তাও MND রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের মানসিক চাপ কমাতে এবং জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

মটর নিউরন ডিজিজ এর জন্য বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

মটর নিউরন ডিজিজ এর জন্য বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) রোগীদের জন্য ফিজিওথেরাপি একটি অত্যন্ত জরুরি এবং সহায়ক চিকিৎসা। এই রোগের কারণে যখন শরীরের পেশীগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ফিজিওথেরাপিই পারে সেই দুর্বলতা সামাল দিতে এবং দৈনন্দিন জীবনকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করতে। এটি কেবল কিছু ব্যায়ামের সমষ্টি নয়, বরং রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করা একটি ব্যক্তিগতকৃত পরিকল্পনা, যা তার শরীর এবং মনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ফিজিওথেরাপির প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো:

  • পেশীর দুর্বলতা কমানো ও শক্তি বৃদ্ধি: MND-এর কারণে পেশী শক্তি হারাতে শুরু করে। ফিজিওথেরাপিস্টরা এমন কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম শেখান যা অবশিষ্ট পেশীগুলোকে শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে এবং তাদের ক্ষয় হওয়া কিছুটা হলেও ধীর করে। এর ফলে রোগীরা দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারেন।
  • পেশী খিঁচুনি ও ব্যথা কমানো: MND রোগীদের প্রায়ই পেশীতে তীব্র খিঁচুনি এবং ব্যথা হয়। ফিজিওথেরাপি এই ব্যথা ও খিঁচুনি কমাতে সাহায্য করে, যেমন স্ট্রেচিং বা আলতো ম্যাসাজের মাধ্যমে পেশীগুলোকে শিথিল করা হয়। এতে রোগী অনেকটাই স্বস্তি অনুভব করেন।
  • শরীরের নমনীয়তা বজায় রাখা: রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যেতে পারে। ফিজিওথেরাপিস্টরা নিয়মিত কিছু নমনীয়তার ব্যায়াম শেখান, যা জয়েন্টগুলোকে সচল রাখতে এবং পেশীগুলোকে টানমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। এতে রোগীর চলাফেরা কিছুটা সহজ হয়।
  • দৈনন্দিন কাজকর্মে স্বনির্ভরতা বাড়ানো: ফিজিওথেরাপি রোগীদের শেখায় কীভাবে দুর্বল পেশী নিয়েও দৈনন্দিন কাজগুলো (যেমন পোশাক পরা, খাওয়া বা চলাফেরা) দক্ষতার সাথে করতে হয়। প্রয়োজনে, ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীর জন্য হাঁটার লাঠি, ওয়াকার, হুইলচেয়ার বা অন্যান্য সহায়ক ডিভাইসের পরামর্শ দেন, যা তাদের চলাফেরার স্বাধীনতাকে অনেকটাই ফিরিয়ে দেয়।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতা উন্নত করা: MND যখন শ্বাসযন্ত্রের পেশীগুলোকে প্রভাবিত করে, তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ফিজিওথেরাপিস্টরা এমন কিছু শ্বাস-ব্যায়াম শেখান যা ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করে।
  • রোগীর সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা: ফিজিওথেরাপি শুধু শারীরিক উন্নতিতেই সাহায্য করে না, এটি রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সক্রিয় থাকা রোগীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং হতাশা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিটি সেশন রোগীর বর্তমান অবস্থা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়, যা রোগের প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ সহায়তা নিশ্চিত করে।

উপসংহার

মটর নিউরন ডিজিজ (MND) একটি গুরুতর স্নায়বিক রোগ, যা আমাদের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের ভেতরের মটর নিউরন নামে পরিচিত বিশেষ কিছু স্নায়ু কোষকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। এই মটর নিউরনগুলোই আমাদের হাত-পা নড়াচড়া করা, কথা বলা, খাবার গিলতে পারা, এমনকি শ্বাস নেওয়ার মতো সব ইচ্ছামতো কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই নিউরনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তখন তারা পেশীগুলোর কাছে সঠিক বার্তা পাঠাতে পারে না। ফলে পেশীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, শুকিয়ে যেতে শুরু করে, এবং শেষ পর্যন্ত অচল হয়ে যেতে পারে। এই রোগকে অনেকেই অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (ALS) বা লু গেরিগ’স ডিজিজ নামেও চেনেন।

MND হলে শরীরের ওপর এর প্রভাব ধীরে ধীরে বোঝা যায়। শুরুতে হয়তো হাত বা পায়ের পেশীতে হালকা দুর্বলতা, টান ধরা বা কাঁপুনি অনুভব হতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই দুর্বলতা বাড়তে থাকে এবং দৈনন্দিন সাধারণ কাজগুলো করাও কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন, সিঁড়ি ভাঙা, বোতাম লাগানো, এমনকি খাবার খাওয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে। কথা বলা জড়িয়ে যেতে পারে এবং খাবার গিলতে সমস্যা হওয়ায় পুষ্টির অভাবে ওজনও কমে যেতে পারে।

দুঃখজনকভাবে, এই রোগের কোনো সম্পূর্ণ নিরাময় এখনও নেই। তবে, বর্তমানে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা রোগের লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনকে যতটা সম্ভব আরামদায়ক করতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি এবং অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থাগুলো রোগীদের দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাশে থাকে। এর মাধ্যমে রোগীরা নিজেদের জীবনযাপনের মান ধরে রাখতে পারেন এবং রোগ সত্ত্বেও একটি কার্যকর জীবনযাপন করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top