ডিস্ক প্রলাপ্স কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

ডিস্ক প্রলাপ্স কি, কেন হয়, কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

ডিস্ক প্রলাপ্স কী?

ডিস্ক প্রলাপ্স, যা সাধারণত হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্লিপড ডিস্ক নামে পরিচিত, মেরুদণ্ডের একটি সাধারণ সমস্যা। আমাদের মেরুদণ্ড অনেকগুলো ছোট ছোট হাড় বা কশেরুকা (vertebrae) দিয়ে গঠিত। এই কশেরুকাগুলোর মাঝে নরম, জেলি-সদৃশ এক ধরনের কুশন থাকে, যাকে ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক বলা হয়। এই ডিস্কগুলো আমাদের মেরুদণ্ডকে নড়াচড়া করতে সাহায্য করে এবং হাঁটাচলার সময় বা আঘাত লাগলে শক বা চাপ শোষণ করে।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ডিস্ক প্রলাপ্স ঘটে যখন এই ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্কের বাইরের শক্ত আবরণ (অ্যানুলাস ফাইব্রোসাস) কোনো কারণে ফেটে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর ভিতরের নরম, জেলি-সদৃশ অংশ (নিউক্লিয়াস পালপোসাস) বাইরে বেরিয়ে আসে। এই বেরিয়ে আসা অংশটি মেরুদণ্ডের কাছাকাছি থাকা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ব্যথা, অসাড়তা বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।

ডিস্ক প্রলাপ্সের অবস্থান

ডিস্ক প্রলাপ্স শরীরের যেকোনো মেরুদণ্ডে হতে পারে, তবে এটি সাধারণত দুটি জায়গায় বেশি দেখা যায়:

  • ঘাড়ের মেরুদণ্ড (সারভাইক্যাল স্পাইন): ঘাড়ে ব্যথা, হাত বা আঙুলে অসাড়তা বা ঝিনঝিন করা এর প্রধান লক্ষণ।
  • কোমরের মেরুদণ্ড (লাম্বার স্পাইন): কোমরে ব্যথা, যা পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, পা দুর্বল হয়ে যাওয়া বা অসাড় লাগা এর সাধারণ লক্ষণ।
  • বুকের মেরুদণ্ড (থোরাসিক স্পাইন): এই অংশে ডিস্ক প্রলাপ্স খুব কম দেখা যায়।

ডিস্ক কীভাবে কাজ করে?

আমাদের মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো অনেকটা গাড়ির টায়ারের মতো। বাইরের দিকটা শক্ত রাবারের মতো এবং ভেতরটা নরম জেলির মতো। এই জেলি-সদৃশ অংশটি শরীরের ওজন এবং চাপ শোষণ করে। ডিস্কের এই গঠন মেরুদণ্ডকে বাঁকানো, মোচড়ানো এবং বিভিন্ন দিকে নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। যখন আমরা লাফাই বা দৌড়াই, তখন এই ডিস্কগুলো শক অ্যাবজরবার হিসেবে কাজ করে মেরুদণ্ডকে রক্ষা করে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা আঘাতের কারণে এই ডিস্কগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। যখন ডিস্কের বাইরের আবরণ দুর্বল হয়ে যায় বা ফেটে যায়, তখন ভেতরের নরম অংশটি বেরিয়ে এসে আশেপাশের স্নায়ুতে চাপ দেয়, যা ডিস্ক প্রলাপ্স নামে পরিচিত।

ডিস্ক প্রলাপ্সের প্রকারভেদ

ডিস্ক প্রলাপ্স বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা ডিস্কের ক্ষতির মাত্রার ওপর নির্ভর করে:

  • প্রোট্রুশন (Bulging Disc): এক্ষেত্রে ডিস্কের বাইরের আবরণ দুর্বল হয়ে যায় এবং ডিস্কটি কিছুটা বাইরের দিকে ফুলে ওঠে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ফেটে যায় না। এটি ডিস্কের আংশিক স্থানচ্যুতি।
  • এক্সট্রুশন (Herniation): এই অবস্থায় ডিস্কের বাইরের আবরণ সম্পূর্ণ ফেটে যায় এবং ভেতরের জেলি-সদৃশ অংশটি বাইরে বেরিয়ে আসে। তবে, এই বেরিয়ে আসা অংশটি তখনও ডিস্কের সাথে সংযুক্ত থাকে
  • সিকোয়েস্ট্রেশন (Sequestered Disc): এটি ডিস্ক প্রলাপ্সের সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা। এক্ষেত্রে ডিস্কের ভেতরের অংশটি ফেটে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মেরুদণ্ডের স্নায়ুর মধ্যে বা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্ন অংশটি স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

মাইগ্রেন নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

ডিস্ক প্রলাপ্স এর কারণসমূহ

ডিস্ক প্রলাপ্স এর কারণসমূহ

ডিস্ক প্রলাপ্স কেন হয়, তা বুঝতে পারলে আমরা প্রতিরোধের উপায়ও জানতে পারি। সাধারণত কয়েকটি কারণে ডিস্ক তার স্বাভাবিক জায়গা থেকে সরে গিয়ে স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে। চলুন, সহজ ভাষায় কারণগুলো জেনে নিই:

  • মেরুদণ্ডের পেশী ও লিগামেন্ট দুর্বল হয়ে যাওয়া: আমাদের মেরুদণ্ডকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে চারপাশে অনেক পেশী ও লিগামেন্ট (এক ধরনের শক্ত টিস্যু যা হাড়কে হাড়ের সাথে যুক্ত করে) থাকে। যখন এই পেশী ও লিগামেন্টগুলো দুর্বল হয়ে যায়, তখন মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো পর্যাপ্ত সমর্থন পায় না। এর ফলে সামান্য চাপ বা নড়াচড়াতেও ডিস্ক তার স্থান থেকে সরে যেতে পারে। অনেকটা যেমন একটি ভাঙা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গেলে সেটি নড়ে যায়, তেমন আর কী!
  • সামনের দিকে ঝুঁকে ভারী ওজন তোলা বা হঠাৎ আঘাত পাওয়া: এটি ডিস্ক প্রলাপ্সের একটি প্রধান কারণ। যখন আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে হঠাৎ করে বা ভুল ভঙ্গিতে কোনো ভারী জিনিস তুলি, তখন মেরুদণ্ডের ডিস্কের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত চাপের কারণে ডিস্কের বাইরের আবরণ ফেটে গিয়ে ভেতরের নরম অংশ বেরিয়ে আসতে পারে। খেলাধুলা বা দুর্ঘটনার কারণে হঠাৎ আঘাত পেলেও এমনটা হতে পারে। ধরুন, আপনি এক বস্তা চাল ভুলভাবে তুলতে গেলেন, আর সাথে সাথেই কোমরে টান পড়লো – অনেকটা এমনই।
  • দীর্ঘক্ষণ নিচে বসে কাজ করা বা অসতর্কতামূলক দৈনন্দিন কাজ: যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে কম্পিউটারে কাজ করেন, বা এমন কোনো কাজ করেন যেখানে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়, তাদের ডিস্ক প্রলাপ্সের ঝুঁকি বেশি। কারণ, একটানা ভুল ভঙ্গিতে বসে থাকলে মেরুদণ্ডের ডিস্কের উপর অনবরত চাপ পড়তে থাকে। এমনকি জুতার ফিতা বাঁধার মতো সাধারণ কাজও যদি অসতর্কভাবে করা হয়, তাহলে ডিস্কের উপর হঠাৎ চাপ পড়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
  • উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া: উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গেলে মেরুদণ্ডের উপর সরাসরি এবং তীব্র আঘাত লাগে। এই ধরনের আঘাতের ফলে ডিস্ক ফেটে গিয়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডিস্ক প্রলাপ্স হতে পারে।
  • অতিরিক্ত ওজন এবং খারাপ ভঙ্গি: যাদের ওজন বেশি, তাদের মেরুদণ্ডের উপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত ওজন ডিস্কগুলোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। এছাড়াও, দৈনন্দিন জীবনে হাঁটাচলা, বসা বা দাঁড়ানোর সময় যদি আমাদের ভঙ্গি (posture) সঠিক না হয়, তাহলে মেরুদণ্ডের ডিস্কের উপর অসম চাপ পড়ে। যেমন, কুঁজো হয়ে হাঁটা বা এক কাঁধে ভারী ব্যাগ ঝোলানো – এগুলো দীর্ঘমেয়াদে ডিস্কের ক্ষতি করতে পারে।

সায়াটিকা সম্পর্কে জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

ডিস্ক প্রলাপ্স এর লক্ষণসমূহ

ডিস্ক প্রলাপ্স এর লক্ষণসমূহ

ডিস্ক প্রলাপ্স হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। লক্ষণগুলো ডিস্কের অবস্থান এবং স্নায়ুর উপর চাপের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। নিচে প্রধান লক্ষণগুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো:

  • পিঠ বা ঘাড়ে তীব্র ব্যথা, সাধারণত একপাশে বা নির্দিষ্ট স্থানে: ডিস্ক প্রলাপ্সের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো আক্রান্ত স্থানে তীব্র ব্যথা। যদি কোমরের ডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কোমরের একপাশে বা মাঝখানে ব্যথা হতে পারে। ঘাড়ের ডিস্ক প্রলাপ্স হলে ঘাড়ে ব্যথা হয়। এই ব্যথা সাধারণত একটানা থাকে এবং নড়াচড়া করলে বা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসলে/দাঁড়ালে বেড়ে যায়।
  • পায়ের বা হাতের ব্যথা (সায়াটিকা), যা পিঠ থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ছড়াতে পারে: কোমরের ডিস্ক প্রলাপ্সের ক্ষেত্রে ব্যথা শুধু কোমরে সীমাবদ্ধ না থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। একে সায়াটিকা বলা হয়। সায়াটিক স্নায়ু মেরুদণ্ড থেকে শুরু হয়ে পা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ডিস্ক যখন এই স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন কোমর থেকে নিতম্ব, উরু, পায়ের পেছনের অংশ এবং এমনকি পায়ের পাতা পর্যন্ত তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। ঘাড়ের ডিস্ক প্রলাপ্স হলে ব্যথা ঘাড় থেকে কাঁধ, বাহু এবং হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
  • অসাড়তা, ঝিনঝিন ভাব বা পিন-প্রিকলিং অনুভূতি: স্নায়ুর উপর চাপের কারণে আক্রান্ত স্থানে অসাড়তা বা অনুভূতিহীনতা দেখা দিতে পারে। হাত বা পায়ে “ঝিনঝিন” করা বা “পিন-প্রিকলিং” (যেমন ছোট ছোট সুঁই ফোটার মতো অনুভূতি) অনুভব হতে পারে। এটি অনেকটা যখন আপনার হাত বা পা অনেকক্ষণ ধরে ভুল ভঙ্গিতে থাকার কারণে “ঘুমিয়ে যায়”, তখন যে অনুভূতি হয়, তার মতো।
  • পেশীর দুর্বলতা, যা হাঁটা, দাঁড়ানো বা জিনিস ধরতে অসুবিধা সৃষ্টি করে: স্নায়ুর উপর দীর্ঘক্ষণ চাপ থাকলে সেই স্নায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে আক্রান্ত পা বা হাত দিয়ে কোনো কিছু তুলতে, হাঁটতে, দাঁড়াতে বা এমনকি দৈনন্দিন কাজ করতেও অসুবিধা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পায়ের পেশী দুর্বল হলে পা টেনে টেনে হাঁটতে হতে পারে বা পায়ের পাতা তুলতে অসুবিধা হতে পারে।
  • মেরুদণ্ডের নড়াচড়া সীমাবদ্ধতা ও ব্যথা বৃদ্ধি: ডিস্ক প্রলাপ্সের কারণে মেরুদণ্ডের নড়াচড়া সীমিত হয়ে যায়। সামনে ঝুঁকতে, পেছনে হেলতে বা পাশ ফিরতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়। অনেক সময় ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে রোগী কোনো নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে স্থির থাকতে বাধ্য হয়।
  • তীব্র ক্ষেত্রে প্রসাব বা পায়খানা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা (কডা ইকুইনা সিন্ড্রোম), যা জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন: এটি ডিস্ক প্রলাপ্সের একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং বিরল লক্ষণ। যদি ডিস্কের চাপ মেরুদণ্ডের স্নায়ুর গোছা, যাকে কডা ইকুইনা (cauda equina) বলা হয়, তার উপর পড়ে, তাহলে প্রস্রাব বা পায়খানা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে, যৌনাঙ্গের আশেপাশে অসাড়তা দেখা দিতে পারে এবং পায়ের দুর্বলতা দ্রুত বাড়তে পারে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে জরুরি চিকিৎসা গ্রহণ করা আবশ্যক, কারণ এটি স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে।

নিউরোপ্যাথি নিয়ে ভালোভাবে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

ডিস্ক প্রলাপ্সের প্রতিকার ও চিকিৎসা পদ্ধতি

ডিস্ক প্রলাপ্সের প্রতিকার ও চিকিৎসা পদ্ধতি

ডিস্ক প্রলাপ্সের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যথা কমানো, স্নায়ুর উপর চাপ কমানো এবং মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সার্জারি ছাড়াই বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ডিস্ক প্রলাপ্সের চিকিৎসা করা সম্ভব।

সাধারণ প্রতিকার

ডিস্ক প্রলাপ্স হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং অবস্থার উন্নতি হতে পারে:

  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম: তীব্র ব্যথার সময় সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। এই সময়ে হাঁটাচলা, বাঁকা হয়ে বসা বা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা এড়িয়ে চলুন। বিশ্রাম ডিস্কের ওপর চাপ কমায় এবং নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তবে, দীর্ঘদিনের সম্পূর্ণ বিছানা বিশ্রাম উল্টো পেশী দুর্বল করে দিতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা নড়াচড়া বা হাঁটাচলার প্রয়োজন হতে পারে।
  • ভারী কাজ থেকে বিরত থাকা: যেকোনো ধরনের ভারী কাজ, বিশেষ করে সামনে ঝুঁকে ভারী ওজন তোলা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। এই ধরনের কাজ ডিস্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে, যা অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে। এমনকি দৈনন্দিন কাজ যেমন ঘর মোছা, কাপড় নিংড়ানো ইত্যাদি থেকেও বিরত থাকুন।
  • সঠিক শোয়ার ভঙ্গি: ঘুমের সময় মাঝারি শক্তির বিছানা (খুব শক্ত বা খুব নরম নয়) ব্যবহার করা উচিত। ঘুমানোর সময় মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে সাহায্য করে এমন মধ্যম সাইজের বালিশ ব্যবহার করুন। যদি চিত হয়ে ঘুমান, তাহলে হাঁটুর নিচে একটি ছোট বালিশ রাখতে পারেন। পাশ ফিরে শুলে দুই হাঁটুর মাঝে একটি বালিশ ব্যবহার করুন।
  • মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেওয়া: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সারভাইক্যাল কলার (ঘাড়ের ডিস্ক প্রলাপ্সের জন্য) বা লাম্বার করসেট (কোমরের ডিস্ক প্রলাপ্সের জন্য) ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো মেরুদণ্ডকে স্থির রাখতে এবং অতিরিক্ত নড়াচড়া রোধ করে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তবে, দীর্ঘক্ষণ ধরে করসেট ব্যবহার করলে পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে, তাই চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

ডিস্ক প্রলাপ্সের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি অত্যন্ত কার্যকর এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ফিজিওথেরাপিস্টরা ডিস্ক প্রলাপ্সের ধরন এবং রোগীর অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট কিছু থেরাপি এবং ব্যায়ামের পরামর্শ দেন।

  • থেরাপিউটিক ব্যায়াম: ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
    • স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ: এটি টান টান পেশীগুলোকে শিথিল করতে এবং মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বাড়াতে সাহায্য করে।
    • কোর স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজ: এই ব্যায়ামগুলো পেটের এবং পিঠের গভীর পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে, যা মেরুদণ্ডকে মজবুত ভিত্তি দেয় এবং ডিস্কের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে। শক্তিশালী ‘কোর’ পেশী মেরুদণ্ডকে স্থিতিশীল রাখে।
    • নিয়মিত এই ব্যায়ামগুলো করলে মেরুদণ্ডের পেশী শক্তিশালী হয় এবং ডিস্কের ওপর চাপ কমে।
  • ম্যানুয়াল ও ম্যানিপুলেশন থেরাপি: ফিজিওথেরাপিস্টরা হাতের সাহায্যে কিছু বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করেন যা ব্যথা কমাতে এবং মেরুদণ্ডের নড়াচড়ার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি পেশী শিথিল করতে এবং জয়েন্টের গতিশীলতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
  • গরম সেঁক এবং বরফ প্রয়োগ: ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রদাহ কমাতে বরফ প্রয়োগ করা হয়। পরে পেশী শিথিল করতে এবং রক্ত ​​সঞ্চালন বাড়াতে গরম সেঁক দেওয়া হয়।
  • চিকিৎসার সময়কাল: ফিজিওথেরাপি সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত দিনে দু-তিনবার দেওয়া হয়। তবে, রোগীর অবস্থার উন্নতির ওপর নির্ভর করে এর সময়কাল কমবেশি হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফিজিওথেরাপিস্টের নির্দেশিত ব্যায়ামগুলো নিয়মিত বাড়িতে চালিয়ে যাওয়া, এমনকি ব্যথা কমে গেলেও। এটি পুনরায় ডিস্ক প্রলাপ্স হওয়া থেকে রক্ষা করে।

স্পাইনাল কর্ড কি, কেন হয় ও তা নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ুন।

জীবনযাপনে সতর্কতা ও প্রতিরোধ

জীবনযাপনে সতর্কতা ও প্রতিরোধ

ডিস্ক প্রলাপ্স একবার হয়ে গেলে যেমন কষ্টের, তেমনি এটি যাতে না হয় তার জন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা খুব জরুরি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করে আমরা ডিস্ক প্রলাপ্সের ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারি। এমনকি যদি ডিস্ক প্রলাপ্স হয়েও যায়, সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি রোগ মুক্তির প্রক্রিয়াকে দ্রুত করতে সাহায্য করে।

  • সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা, বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ বসার সময়: আমাদের বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটার ভঙ্গি (Posture) মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করি, তখন প্রায়শই কুঁজো হয়ে বসি বা মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে রাখি। এতে ডিস্কের ওপর অসম চাপ পড়ে, যা ধীরে ধীরে ডিস্ককে দুর্বল করে দেয়। বসার সময় মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। চেয়ারের পিঠ হেলান দিয়ে বসুন এবং নিশ্চিত করুন যে আপনার কোমর চেয়ারের সাথে লেগে আছে। প্রয়োজনে কোমরের পেছনে একটি ছোট কুশন বা রোল করা তোয়ালে ব্যবহার করতে পারেন। কম্পিউটারে কাজ করার সময় মনিটর চোখের লেভেলে রাখুন যাতে ঘাড় বাঁকাতে না হয়। প্রতি ৩০-৪০ মিনিট পর পর উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন বা হালকা স্ট্রেচিং করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম মেরুদণ্ডের পেশী শক্তিশালী করে: ব্যায়াম শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না, এটি আমাদের মেরুদণ্ডের চারপাশের পেশীগুলোকেও শক্তিশালী করে। শক্তিশালী পেশীগুলো মেরুদণ্ডকে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ডিস্কের ওপর চাপ কমায়। নিয়মিত হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম করুন। সাঁতার, হাঁটা, সাইক্লিং অথবা ফিজিওথেরাপিস্টের নির্দেশিত মেরুদণ্ডের জন্য উপকারী ব্যায়ামগুলো করতে পারেন। যোগব্যায়াম এবং পাইলেটসও কোর মাসেল (পেট ও পিঠের গভীর পেশী) শক্তিশালী করতে খুব কার্যকর। তবে, কোনো কঠিন ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • ভারী ওজন তোলার সময় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা: আমরা প্রায়শই ভুলভাবে ভারী জিনিস তুলে থাকি, যা সরাসরি ডিস্কের ওপর মারাত্মক চাপ ফেলে। যখনই কোনো ভারী জিনিস তুলবেন, তখন মেরুদণ্ড সোজা রেখে হাঁটু বাঁকিয়ে বসুন। এরপর জিনিসটি ধরে পায়ের পেশীর শক্তি ব্যবহার করে সোজা হয়ে দাঁড়ান। পিঠ বাঁকিয়ে বা কোমর থেকে ঝুঁকে কোনো ভারী জিনিস তোলার চেষ্টা করবেন না। যদি জিনিসটি খুব বেশি ভারী হয়, তাহলে অন্যের সাহায্য নিন।
  • অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: শরীরের অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ড এবং ডিস্কের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এই অতিরিক্ত চাপ ডিস্কের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং ডিস্ক প্রলাপ্সের ঝুঁকি বাড়ায়। সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শুধুমাত্র ডিস্ক প্রলাপ্স নয়, অন্যান্য অনেক রোগ থেকেও আপনাকে রক্ষা করবে।
  • ধূমপান পরিহার করা: ধূমপান শুধু ফুসফুসের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি মেরুদণ্ডের ডিস্কের স্বাস্থ্যের জন্যও খারাপ। ধূমপান ডিস্কে রক্ত ​​প্রবাহ কমিয়ে দেয়, যা ডিস্কের পুষ্টি সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ডিস্ককে দুর্বল করে তোলে। ধূমপান সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করুন। এটি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে।

ডিস্ক প্রলাপ্সের ক্ষেত্রে চিকিৎসা এবং সুস্থতা

যদি আপনার ডিস্ক প্রলাপ্স হয়েই থাকে, তাহলে হতাশ হবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনলে সুস্থ হওয়া সম্ভব।

ডিস্ক প্রলাপ্সের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসক আপনার অবস্থা নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন, যার মধ্যে ওষুধ, বিশ্রাম এবং অবশ্যই ফিজিওথেরাপি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ফিজিওথেরাপি ডিস্ক প্রলাপ্সের অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা, যা ব্যথা কমাতে, পেশী শক্তিশালী করতে এবং নড়াচড়ার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

মনে রাখবেন, অধিকাংশ রোগীই (প্রায় ৯০%) ৬-১২ সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেন যদি তারা সঠিক চিকিৎসা এবং ফিজিওথেরাপি গ্রহণ করেন। তবে, যদি লক্ষণগুলো খুব তীব্র হয়, যেমন – প্রচণ্ড ব্যথা যা কমছে না, পেশীর দুর্বলতা দ্রুত বাড়ছে, বা প্রস্রাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে (কডা ইকুইনা সিন্ড্রোম), তাহলে দ্রুততম সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।  এই ধরনের ক্ষেত্রে অনেক সময় সার্জারিরও প্রয়োজন হতে পারে।

শেষ কথা

ডিস্ক প্রলাপ্স, যা স্লিপড ডিস্ক নামে পরিচিত, মেরুদণ্ডের একটি পরিচিত সমস্যা যেখানে ডিস্কের ভেতরের নরম অংশ বেরিয়ে এসে স্নায়ুতে চাপ দেয়। ভুলভাবে ভারী জিনিস তোলা, দীর্ঘক্ষণ ভুল ভঙ্গিতে বসা, বা অতিরিক্ত ওজন এর প্রধান কারণ। এর ফলে পিঠ বা ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হয়, যা হাত বা পা পর্যন্ত ছড়াতে পারে (যেমন সায়াটিকা), এবং আক্রান্ত স্থানে অসাড়তা বা পেশীর দুর্বলতা দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাব বা পায়খানা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা (কডা ইকুইনা সিন্ড্রোম) দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

বেশিরভাগ ডিস্ক প্রলাপ্সের ক্ষেত্রে সার্জারি ছাড়াই চিকিৎসা সম্ভব। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ভারী কাজ এড়িয়ে চলা, এবং সঠিক ভঙ্গিতে শোয়া এর প্রাথমিক প্রতিকার। ফিজিওথেরাপি এই রোগের অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা, যেখানে থেরাপিউটিক ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপি, এবং গরম-ঠান্ডা সেঁক ব্যবহার করে ব্যথা কমানো হয় এবং মেরুদণ্ডের কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা হয়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে বেশিরভাগ রোগীই ৬-১২ সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সঠিক জীবনযাপন, যেমন ভালো ভঙ্গি বজায় রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ধূমপান ত্যাগ, ডিস্ক প্রলাপ্স প্রতিরোধে অত্যন্ত সহায়ক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top