পারকিনসন ডিজিজঃ কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

পারকিনসন ডিজিজঃ কি? কেন হয়? কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

Table of Contents

পারকিনসন ডিজিজ কি?

পারকিনসন ডিজিজ হলো মস্তিষ্কের একটি জটিল রোগ যা ধীরে ধীরে বাড়ে এবং শরীরের নড়াচড়ায় সমস্যা তৈরি করে। আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে কিছু বিশেষ কোষ থাকে, যাদের প্রধান কাজ হলো ডোপামিন নামের একটি খুব দরকারি রাসায়নিক তৈরি করা। এই ডোপামিনই আমাদের শরীরকে সহজে নড়াচড়া করতে, হাঁটতে, হাত নাড়াতে এবং আমাদের পেশিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যখন পারকিনসন ডিজিজ হয়, তখন এই ডোপামিন তৈরি করা কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এর ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ অনেক কমে যায় এবং তখনই এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে।

ডোপামিন কমে গেলে আমাদের শরীরের পেশিগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এর কারণে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়:

  • শরীর কাঁপা: সাধারণত হাত বা পায়ের আঙুল কাঁপে, বিশেষ করে যখন বিশ্রাম নেওয়া হয়। এই কাঁপুনি ঘুমের সময় বাড়ে না।
  • পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া: শরীর বা হাত-পা শক্ত হয়ে যায়, যার কারণে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়। এটি অনেকটা জং ধরা কব্জার মতো লাগে। এই শক্ত ভাব ব্যথাও তৈরি করতে পারে।
  • ধীর গতি: যেকোনো কাজ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। যেমন – হাঁটাচলা, জামাকাপড় পরা বা খাওয়া-দাওয়া করা। রোগীর চলাফেরাও খুব ধীর ও ছোট ছোট পদক্ষেপের হয়ে যায়।
  • ভারসাম্যের সমস্যা: হাঁটার সময় ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হয়, যার কারণে হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।

এই শারীরিক লক্ষণগুলোর পাশাপাশি, পারকিনসন ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের ঘুমের সমস্যা, কোনো কিছু ভুলে যাওয়া (স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা) এবং মন খারাপ থাকা বা বিষণ্নতার মতো অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। 

যদিও পারকিনসন ডিজিজ পুরোপুরি সারানো যায় না, তবে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে অনেক কার্যকর চিকিৎসা আছে। ওষুধ যেমন – লেভোডোপা, মস্তিষ্কে কমে যাওয়া ডোপামিনের অভাব পূরণ করে লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি, শারীরিক ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপি শরীরের নড়াচড়ার ক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং পেশিগুলোকে সচল রাখে। অকুপেশনাল থেরাপি রোগীদের দৈনন্দিন কাজগুলো (যেমন – খাওয়া, পোশাক পরা) আরও সহজে করার উপায় শেখায়। কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে অপারেশনও করা হয়, যাকে ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন (DBS) বলে। এই অপারেশনে মস্তিষ্কে ছোট ইলেকট্রোড বসানো হয় যা মস্তিষ্কের ভুল সংকেতগুলোকে ঠিক করে। সঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়লে, নিয়মিত চিকিৎসা নিলে এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে, পারকিনসন ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও অনেক বছর সুস্থ ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন।

পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ জেনে নিন।

কেন হয় এই পারকিনসন ডিজিজ

কেন হয় এই পারকিনসন ডিজিজ?

এই পারকিনসন রোগ হওয়ার বিস্তারিত কারণগুলো নিচে দেওয়া হলোঃ

পারকিনসন ডিজিজ কেন হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কারণগুলো একে অপরের সাথে মিশে রোগটি তৈরি করতে পারে:

মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কোষের ক্ষতি

পারকিনসন ডিজিজের মূল কারণ হলো আমাদের মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ স্নায়ুকোষের ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই কোষগুলো মস্তিষ্কের গভীরে অবস্থিত এবং এদের প্রধান কাজ হলো ডোপামিন নামক একটি জরুরি রাসায়নিক তৈরি করা। ডোপামিন আমাদের শরীরকে মসৃণভাবে নড়াচড়া করতে, পেশি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যখন এই ডোপামিন তৈরি করা কোষগুলো কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যায়, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। পর্যাপ্ত ডোপামিন না থাকলে শরীর নড়াচড়ার সংকেতগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না, যার ফলে পারকিনসন ডিজিজের পরিচিত লক্ষণগুলো যেমন – কাঁপুনি, পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া এবং চলাফেরার ধীরগতি দেখা দেয়।

বয়স বাড়ার প্রভাব

বয়স বেড়ে যাওয়া পারকিনসন ডিজিজের একটি বড় ঝুঁকির কারণ। সাধারণত, ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়, যদিও কম বয়সেও এটি হতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের ডোপামিন উৎপাদনকারী কোষগুলো স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কার্যকারিতা হারায় বা সংখ্যায় কমে যায়। তাই, বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডোপামিনের মাত্রা কমে যাওয়া এবং পারকিনসন ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটি বয়সজনিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলেও, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি রোগের দিকে ঠেলে দেয়।

জিনগত কারণ এবং পারিবারিক ইতিহাস

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে জিনগত কারণ পারকিনসন ডিজিজ হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। এর মানে হলো, যদি আপনার পরিবারের কারো (যেমন – বাবা, মা, দাদা-দাদি) পারকিনসন ডিজিজ থাকে, তাহলে আপনারও এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় সামান্য বেশি হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু জিনের পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন যা পারকিনসন ডিজিজের সাথে সম্পর্কিত। এই জিনগুলো মস্তিষ্কের কোষের স্বাস্থ্য, ডোপামিন তৈরি এবং প্রোটিনের সঠিক কাজ করার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারকিনসন ডিজিজ জিনগত কারণে হয় না, বরং এটি বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে ঘটে।

পরিবেশের প্রভাব এবং মাথায় আঘাত

আমাদের পরিবেশের কিছু বিষয়ও পারকিনসন ডিজিজের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিছু বিষাক্ত কীটনাশক বা রাসায়নিকের দীর্ঘদিনের সংস্পর্শ এই রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এসব রাসায়নিক মস্তিষ্কের ডোপামিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়াও, মাথায় গুরুতর আঘাত (যেমন – কোনো দুর্ঘটনা বা খেলাধুলার সময় বারবার মাথায় আঘাত লাগা) পারকিনসন ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি মস্তিষ্কের কোষগুলোতে স্থায়ী ক্ষতি তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ডোপামিনের অভাব ঘটায়।

মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক প্রোটিনের জমা

বিজ্ঞানীরা আরও দেখেছেন যে, পারকিনসন ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু প্রোটিন জমা হয়, যাকে “লেউই বডিজ” (Lewy Bodies) বলা হয়। এই লেউই বডিজগুলো মূলত আলফা-সিনুক্লিন (alpha-synuclein) নামক একটি প্রোটিনের অস্বাভাবিক জমাট বাঁধা রূপ। এই প্রোটিন জমা হলে স্নায়ুকোষগুলোর স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয় এবং শেষ পর্যন্ত কোষগুলো মারা যায়। এটি ডোপামিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে রোগের লক্ষণগুলো আরও প্রকট হয়। এই প্রোটিনগুলো কীভাবে জমা হয় এবং কেন তারা কোষের ক্ষতি করে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।

পারকিনসন রোগের লক্ষণসমূহ

পারকিনসন রোগের লক্ষণসমূহ

পারকিনসন ডিজিজ হলে রোগীর শরীরে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে বাড়ে। এই লক্ষণগুলো সাধারণত নড়াচড়া বা চলাফেরার সঙ্গে জড়িত। নিচে বিস্তারিতভাবে লক্ষণগুলো সহজ ভাষায় তুলে ধরা হলোঃ

বিশ্রামরত অবস্থায় কাঁপুনি বা ঝাঁকুনি

পারকিনসন রোগের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। রোগী যখন বিশ্রামে থাকেন, অর্থাৎ কোনো কাজ করছেন না, তখন তার হাত বা শরীরের যেকোনো একপাশে কাঁপুনি বা ঝাঁকুনি দেখা দিতে পারে। এই কাঁপুনি আঙুল, হাত বা এমনকি পায়ের পাতায়ও হতে পারে। অনেক সময় রোগী নিজের অজান্তেই তার হাতের আঙুলগুলো এমনভাবে নাড়েন যেন কিছু রোল করছেন (একে “পিল-রোলিং ট্রে মর” বলা হয়)। ঘুমিয়ে থাকলে এই কাঁপুনি সাধারণত কমে যায় বা থেমে যায়।

পেশির শক্ত হয়ে যাওয়া বা অনমনীয়তা

পারকিনসন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পেশিগুলো শক্ত বা অনমনীয় হয়ে যায়। এর মানে হলো, শরীর বা হাত-পা নাড়াচাড়া করতে বেশ কষ্ট হয়, অনেকটা কঠিন বা জং ধরা কব্জার মতো মনে হয়। এই শক্ত ভাব শরীরের যেকোনো অংশে হতে পারে এবং এর কারণে ব্যথা বা অস্বস্তিও হতে পারে। যেমন, হাত-পা বাঁকাতে বা সোজা করতে সমস্যা হতে পারে। এর ফলে রোগী কুঁজো হয়ে হাঁটতে পারেন বা তার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিকের চেয়ে আলাদা হতে পারে।

চলাফেরার ধীরগতি ও ভারসাম্যের সমস্যা

পারকিনসন রোগের একটি প্রধান লক্ষণ হলো চলাফেরার ধীরগতি (Bradykinesia)। এর মানে হলো, রোগী যেকোনো কাজ করতে অনেক বেশি সময় নেন এবং তাদের নড়াচড়ার গতি কমে যায়। যেমন, হাঁটতে শুরু করতে দেরি হওয়া, খুব ছোট ছোট কদমে হাঁটা (অনেকটা পা টেনে হাঁটার মতো), বা হঠাৎ করে থেমে যাওয়া। এর পাশাপাশি, তাদের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সমস্যা হয়, যার ফলে সহজে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বা মোড় ঘোরার সময় এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।

মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন ও কথা বলার অসুবিধা

পারকিনসন ডিজিজের কারণে রোগীর মুখের অভিব্যক্তি কমে যেতে পারে। তাদের মুখমণ্ডল দেখে মনে হতে পারে যে কোনো আবেগ নেই, বা তারা খুব গম্ভীর। একে অনেক সময় “মাস্কড ফেস” বলা হয়। এর কারণ হলো মুখের পেশিগুলোও শক্ত হয়ে যায় বা নড়াচড়ায় ধীরগতি আসে। এছাড়াও, কথা বলার ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দিতে পারে। রোগীর কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে যেতে পারে (monotone), কথা জড়িয়ে যেতে পারে বা কথা বলার গতি ধীর হতে পারে।

শরীরের স্বাভাবিক নড়াচড়ায় হ্রাস

সাধারণত আমরা হাঁটার সময় বা কথা বলার সময় আমাদের হাত-পা স্বাভাবিকভাবেই নাড়ি। পারকিনসন রোগের কারণে শরীরের এই স্বাভাবিক নড়াচড়াগুলো কমে যায়। যেমন, হাঁটার সময় হাত স্বাভাবিকভাবে দোলানো কমে যেতে পারে বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চোখ পিটপিট করা বা ঢোক গেলাও কমে যেতে পারে, যার ফলে চোখ শুকনো হয়ে যাওয়া বা লালা ঝরার সমস্যা হতে পারে। দৈনন্দিন অনেক ছোট ছোট কাজ, যেমন – বোতাম লাগানো, লেখা বা ব্রাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। লেখার সময় অক্ষর ছোট হয়ে আসা (micrographia) একটি পরিচিত লক্ষণ।

৬. অন্যান্য সমস্যা: ঘুম, মন ও স্মৃতি

শারীরিক লক্ষণগুলোর পাশাপাশি পারকিনসন রোগীদের আরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে:

  • ঘুমের সমস্যা: রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হওয়া বা দিনে অতিরিক্ত ঘুম আসা।
  • বিষণ্নতা: মন খারাপ থাকা, হতাশা বা বিষণ্নতায় ভোগা।
  • ক্লান্তি: সারাক্ষণ অবসাদ বা ক্লান্তি অনুভব করা, এমনকি বিশ্রাম নিলেও ক্লান্তি না কমা।
  • স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া: কোনো কিছু মনে রাখতে বা মনোযোগ দিতে সমস্যা হওয়া।

পারকিনসন ডিজিজঃ কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

পারকিনসন রোগের প্রতিকার ও চিকিৎসা

পারকিনসন ডিজিজ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব না হলেও, এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করে রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য অনেক কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। মূলত, চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে রোগের লক্ষণগুলো কমানো এবং দৈনন্দিন কাজগুলো সহজ করা।

ওষুধের মাধ্যমে ডোপামিনের ঘাটতি পূরণ

পারকিনসন রোগের প্রধান কারণ হলো মস্তিষ্কে ডোপামিনের অভাব। তাই, চিকিৎসার মূল অংশ হলো ওষুধের মাধ্যমে এই অভাব পূরণ করা। সবচেয়ে পরিচিত এবং কার্যকর ওষুধ হলো লেভোডোপা (Levodopa)। এই ওষুধ শরীরে প্রবেশ করার পর মস্তিষ্কে ডোপামিনে রূপান্তরিত হয় এবং ডোপামিনের ঘাটতি পূরণ করে। এর ফলে রোগীর কাঁপুনি, পেশির শক্ত হওয়া এবং চলাফেরার ধীরগতি অনেকটাই কমে আসে। এছাড়াও, কিছু ওষুধ আছে যা ডোপামিনের কার্যকারিতা বাড়ায় অথবা মস্তিষ্কে ডোপামিনকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে সাহায্য করে। রোগীর অবস্থা বুঝে ডাক্তার বিভিন্ন ধরনের ওষুধ একসাথে দিতে পারেন।

ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম

পেশির শক্তি এবং চলাফেরার উন্নতির জন্য ফিজিওথেরাপি (Physiotherapy) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর জন্য বিশেষ কিছু ব্যায়াম নির্ধারণ করেন, যা পেশিগুলোকে নমনীয় রাখতে এবং শক্ত হওয়া কমাতে সাহায্য করে। এই ব্যায়ামগুলো রোগীর ভারসাম্য উন্নত করে, হাঁটার ক্ষমতা বাড়ায় এবং পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি রোগীর স্বাধীনভাবে চলাচলের ক্ষমতা বজায় রাখতে এবং দৈনন্দিন কাজগুলো আরও সহজে করতে সাহায্য করে।

রোগের ধাপ অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা

পারকিনসন ডিজিজ একটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা রোগ। তাই, রোগীর রোগের কোন ধাপে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়। রোগের প্রথম দিকে হয়তো কম ওষুধের প্রয়োজন হয়, কিন্তু রোগ বাড়ার সাথে সাথে ওষুধের মাত্রা বা ধরন পরিবর্তন করতে হতে পারে। ডাক্তার রোগীর লক্ষণ, বয়স এবং জীবনযাত্রার ধরন বিবেচনা করে একটি ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন। কিছু ক্ষেত্রে, যখন ওষুধ কার্যকর হয় না বা গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তখন গভীর মস্তিষ্ক উদ্দীপনা (Deep Brain Stimulation – DBS) নামক একটি অস্ত্রোপচারের কথাও ভাবা হতে পারে।

মানসিক ও শারীরিক জটিলতার চিকিৎসা

পারকিনসন ডিজিজ শুধু চলাফেরার সমস্যাই সৃষ্টি করে না, এটি রোগীর মানসিক ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও তৈরি করতে পারে। যেমন, অনেক রোগীর ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। এই জটিলতাগুলো রোগীর জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। তাই, এই সমস্যাগুলোর জন্য আলাদাভাবে চিকিৎসা করা হয়। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয় বা ঘুম উন্নত করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে, পারকিনসন ডিজিজের চিকিৎসা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, যেখানে রোগীর শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিকের যত্ন নেওয়া হয়।

পারকিনসন রোগের বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

পারকিনসন রোগের বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

পারকিনসন রোগে ফিজিওথেরাপি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই রোগের কারণে রোগীর পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং চলাচলে অসুবিধা হয়, আর ফিজিওথেরাপি এই সমস্যাগুলো কমাতে এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে রোগীর পেশীর নমনীয়তা ও শক্তি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্যায়াম করানো হয়। এর ফলে পেশিগুলো কম শক্ত থাকে এবং নড়াচড়া করা সহজ হয়। পাশাপাশি, এই ব্যায়ামগুলো শরীরের শক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে, যা রোগীকে দৈনন্দিন কাজকর্মে আরও বেশি সক্ষম করে তোলে। ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি কিছু অনুশীলন করান, যা তাদের ভারসাম্য এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের সমন্বয় (coordination) উন্নত করতে সাহায্য করে। এর ফলে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে এবং রোগী আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে চলাফেরা করতে পারে।

ফিজিওথেরাপির আরও একটি লক্ষ্য হলো রোগীর হাঁটার ক্ষমতা, দাঁড়ানোর ভঙ্গি এবং হাতের কাজ করার দক্ষতা বাড়ানো। যেমন, রোগীকে সঠিক উপায়ে হাঁটতে শেখানো হয়, তাদের শরীরের ভঙ্গি ঠিক রাখতে সাহায্য করা হয় এবং হাতের সূক্ষ্ম কাজগুলো (যেমন – লেখা, বোতাম লাগানো) করার জন্য বিশেষ কৌশল শেখানো হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগী ধীরে ধীরে তার হারিয়ে যাওয়া দক্ষতাগুলো ফিরে পায় এবং দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি স্বনির্ভর হতে পারে। এর ফলে রোগী তার নিজের কাজগুলো নিজেই করতে পারে, যা তার মানসিক স্বাস্থ্যকেও ভালো রাখতে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top