পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ কি

পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ কি?

পারকিনসন রোগ হলো একটা দীর্ঘদিনের স্নায়ুর অসুখ। আমাদের মস্তিষ্কে কিছু কোষ আছে যারা ডোপামিন নামে একটা জিনিস তৈরি করে। এই ডোপামিন আমাদের শরীরের নড়াচড়া, ভারসাম্য আর মাংসপেশি ঠিক রাখতে খুব দরকারি। পারকিনসন হলে এই কোষগুলো নষ্ট হতে শুরু করে। পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

যাদের এই রোগ হয়, তাদের সাধারণত হাত-পা কাঁপে, শরীর শক্ত হয়ে যায়, হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয় এবং শরীরের ব্যালেন্স রাখতে সমস্যা হয়। শুধু তাই না, মন খারাপ থাকা, মনে রাখার সমস্যা আর মনের দিক থেকেও কিছু বদল আসতে পারে। ঠিক কী কারণে এই রোগ হয়, তা এখনো ভালো করে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে বংশগত সমস্যা, পরিবেশের কিছু জিনিস আর বয়স বাড়লে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

এই পারকিনসন রোগ পুরোপুরি ভালো করা যায় না। কিন্তু সঠিক ফিজিওথেরাপি আর জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে এর লক্ষণগুলো কমানো যায়। কিন্তু, এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ভালো চিকিৎসা আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ভালো থাকতে পারে।

গুলেন-বারে সিন্ড্রোমভ নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ুন।

পারকিনসন রোগের লক্ষণ

পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮ টি লক্ষণ

পারকিনসন রোগের বিশেষ ৮টি লক্ষণ হলো:

হাত, পা বা মাথার কম্পন

পারকিনসন রোগের একটি খুব পরিচিত লক্ষণ হলো হাত, পা অথবা মাথার কাঁপুনি। এই কাঁপুনি সাধারণত তখনই বেশি দেখা যায় যখন শরীর বিশ্রাম নিচ্ছে, মানে হাত বা পা যখন কোনো কাজ করছে না অথবা শরীরের কোনো অংশ স্থিরভাবে আছে। এই কাঁপুনি প্রথমে শরীরের যেকোনো এক দিকে শুরু হতে পারে এবং পরে অন্য দিকেও ছড়িয়ে যেতে পারে। এই কাঁপুনি দেখতে অনেকটা এমন মনে হয় যেন আঙুলগুলো কোনো ছোট জিনিস ধরে অনবরত ঘষাঘষি করছে, যাকে “পিল-রো rolling” বলা হয়। এই কাঁпуনির জোর কম বা বেশি হতে পারে, একেকজনের ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন রকম হয়।

দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের সময় এই কাঁপুনি আরও বেড়ে যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু হাত, পা বা মাথায় কাঁপুনি হলেই সেটা পারকিনসন রোগ নয়, অন্য কারণেও এমন হতে পারে।

পেশির শক্ত হওয়া

পারকিনসন রোগের আরেকটি জরুরি লক্ষণ হলো শরীরের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, যাকে রিজিডিটি বলা হয়। এই অবস্থায় শরীরের মাংসগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টানটান এবং সহজে নাড়ানো যায় না। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন হাত, পা নাড়াতে কষ্ট হয় এবং প্রতিদিনের কাজগুলো করতেও সমস্যা হয়। এই শক্ত ভাব শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে, তবে সাধারণত হাত, পা এবং ঘাড়ে বেশি দেখা যায়। মাংসপেশির এই কাঠিন্যের জন্য হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে, শরীরের ব্যালেন্স রাখতে সমস্যা হতে পারে এবং ছোটখাটো কাজ, যেমন বোতাম লাগানো বা জামাকাপড় পরাও কঠিন মনে হতে পারে। অনেক সময় এই মাংসপেশি শক্ত হওয়ার কারণে শরীরে ব্যথাও অনুভূত হতে পারে। পারকিনসন রোগের এই লক্ষণটি সময়ের সাথে সাথে আরও বাড়তে থাকে এবং সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।

ধীরগতির চলাফেরা

পারকিনসন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চলাফেরার গতি কমে যাওয়া একটি খুব সাধারণ লক্ষণ, যাকে ব্র্যাডিকিনেসিয়া বলা হয়। এই অবস্থায় প্রতিদিনের ছোটখাটো কাজগুলো করতেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে এবং সেগুলো শেষ করতেও বেশ অসুবিধা হয়। হাঁটা চলার গতি কমে যায়, পায়ের পদক্ষেপগুলো ছোট ছোট হয় এবং হাঁটার সময় হাত তেমন একটা নড়ে না। শুধু হাঁটাই নয়, অন্যান্য কাজকর্ম যেমন চেয়ার থেকে ওঠা, বিছানায় পাশ ফেরানো, জামাকাপড় পরা বা খাওয়া-দাওয়ার মতো কাজগুলোও ধীরে ধীরে কঠিন মনে হতে থাকে। মনে হতে পারে যেন শরীর তার আগের দ্রুততা হারিয়েছে। এই ধীরগতির কারণে দৈনন্দিন জীবনযাপন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে এবং অন্যের উপর নির্ভরতা বাড়তে পারে।

পারকিনসন রোগে ভারসাম্যহীনতা

ভারসাম্যহীনতা

পারকিনসন রোগের পরবর্তী পর্যায়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা হওয়া একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় শরীর তার স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে সামান্য ধাক্কা লাগলেই বা হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন করলে শরীরের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং বারবার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। শরীরের ভারসাম্য রক্ষার এই দুর্বলতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, চলাফেরার গতি কমে যাওয়া এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া (রিফ্লেক্স) কমে যাওয়া। ভারসাম্যহীনতার কারণে হাঁটতে ভয় লাগতে পারে এবং নিজের উপর বিশ্বাস কমে যেতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ফিজিওথেরাপি এবং অন্যান্য পুনর্বাসন চিকিৎসা অনেক সাহায্য করতে পারে।

কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন

পারকিনসন রোগে যারা আক্রান্ত হন, তাদের গলার আওয়াজে পরিবর্তন আসতে পারে। এই পরিবর্তন খুব ধীরে ধীরে হয় এবং প্রথমে হয়তো তেমন বোঝা যায় না। সময়ের সাথে সাথে গলার স্বর ক্রমশ নরম ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যাকে হাইপোফোনিয়া বলা হয়। এর ফলে অন্যদের কথা শুনতে যেমন অসুবিধা হয়, তেমনই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতেও সমস্যা হতে পারে। শুধু গলার জোর কমে যাওয়া নয়, আরও নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। কারো কারো কথা বলার সময় মনে হতে পারে যেন একই সুরে কথা বলছেন, গলার স্বাভাবিক ওঠা-নামা কমে যায়। আবার কারো কারো কথা আটকে যেতে পারে অথবা তারা খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে শুরু করতে পারে।

এই পরিবর্তনগুলোর জন্য অন্যদের সাথে মেলামেশা করতে এবং নিজের কথা বোঝাতে অসুবিধা হতে পারে। তবে স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে এই সমস্যা কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে।

এই তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকের লক্ষণ জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

পারকিনসন রোগে হাতের লেখার পরিবর্তন

হাতের লেখার পরিবর্তন

পারকিনসন রোগের একটি চেনা লক্ষণ হলো হাতের লেখার পরিবর্তন। এই পরিবর্তনকে মাইক্রোগ্রাফিয়া বলা হয়, যেখানে হাতের লেখা ধীরে ধীরে ছোট ও সরু হয়ে আসে। লেখার প্রথমে অক্ষরগুলো হয়তো স্বাভাবিক আকারের থাকে, কিন্তু যখন একটি লাইন শেষ হতে থাকে, তখন অক্ষরগুলো ছোট এবং খুব কাছাকাছি লেখা হতে শুরু করে, যা পড়তে অসুবিধা হয়। এই পরিবর্তন হওয়ার কারণ হলো হাতের মাংসপেশির stiffness এবং হাতের মুভমেন্টের গতি কমে যাওয়া। কলম ধরা এবং আঙুল নাড়ানোর স্বাভাবিকতা কমে যাওয়ার কারণে লেখার উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। সময়ের সাথে সাথে হাতের লেখা এতটাই ছোট হয়ে যেতে পারে যে অন্যের পক্ষে সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। এই লক্ষণ পারকিনসন রোগের একদম শুরুর দিকেও দেখা যেতে পারে এবং রোগ চেনার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্য ও প্রস্রাবের সমস্যা

পারকিনসন রোগে আক্রান্ত বহু লোকেরই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মূল কারণ হলো পেটের ভেতরের মাংসপেশিগুলোর স্বাভাবিক নড়াচড়া কমে যাওয়া, যাকে পেরিস্টালসিস বলা হয়। এই কারণে খাবার খুব ধীরে ধীরে হজম নালীর মধ্যে দিয়ে যায় এবং মল শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করে। এছাড়াও, পারকিনসন রোগের চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। একইসাথে, পারকিনসন রোগীদের প্রস্রাবের সমস্যাও হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো হঠাৎ করে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ অনুভব করা অথবা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, যাকে ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বলা হয়। পারকিনসন রোগের প্রভাবে শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব পড়ে, যার ফলে মূত্রাশয়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে এবং এই ধরনের সমস্যাগুলো দেখা দেয়।

আই স্ট্রেইন কি, কেন হয় ও প্রতিরোধের উপায় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।

পারকিনসন রোগে মানসিক পরিবর্তন

মানসিক পরিবর্তন

পারকিনসন রোগ কেবল শরীরের সমস্যাই করে না, এটি মনের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিষণ্নতা এবং অস্থিরতা পারকিনসন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যায়। মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং রোগের কারণে প্রতিদিনের জীবনে আসা পরিবর্তনগুলো এর প্রধান কারণ। এছাড়াও, পারকিনসন রোগে স্মৃতি কমে যাওয়া এবং অন্যান্য বুদ্ধিভিত্তিক সমস্যাও হতে পারে। যেমন, কোনো কিছুতে মন বসাতে অসুবিধা হওয়া, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হওয়া এবং সাধারণভাবে চিন্তা করার গতি কমে যাওয়া। সময়ের সাথে সাথে এই মানসিক পরিবর্তনগুলো আরও বাড়তে পারে এবং রোগীর জীবনযাপন এবং অন্যদের সাথে সম্পর্কের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, সঠিক চিকিৎসা এবং সাহায্য পেলে এই সমস্যাগুলো কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে।

পারকিনসন রোগ নিয়ে কিছু বিশেষ সতর্কতা

পারকিনসন রোগ নিয়ে কিছু বিশেষ সতর্কতা

পারকিনসন রোগ একটি জটিল স্নায়বিক অবস্থা, তাই এর মোকাবিলায় কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। প্রথমত, এই রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং একেকজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। তাই, নিজের শরীরের কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শুধুমাত্র কাঁপুনিকেই পারকিনসন রোগের একমাত্র লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত নয়, কারণ আরও অনেক লক্ষণ রয়েছে যা শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করলে রোগের progression ধীর করা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, পারকিনসন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষ করে ব্যালেন্স এবং স্ট্রেচিং-এর উপর জোর দেওয়া উচিত। এতে শরীরের মাংসপেশি সচল থাকে এবং পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে। খাবারদাবারের দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা এবং নিয়মিত ফলো-আপে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ইচ্ছামতো ওষুধের ডোজ পরিবর্তন করা বা বন্ধ করা উচিত নয়।

সবশেষে, পারকিনসন রোগ শুধু রোগীর উপরই নয়, তার পরিবার এবং পরিচর্যাকারীদের উপরও মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। সহায়তা গোষ্ঠী বা সাপোর্ট গ্রুপের সাথে যুক্ত হলে একইরকম পরিস্থিতিতে থাকা অন্যদের অভিজ্ঞতা জানা যায় এবং মানসিক শক্তি পাওয়া যায়। ধৈর্য, সহানুভূতি এবং সঠিক তথ্যের মাধ্যমে পারকিনসন রোগের মোকাবিলা করা সম্ভব এবং একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যেতে পারে।

 

পরামর্শ পেতে – 01711794071 , 01753631846 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।

আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ ফিট বে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *